সম্প্রতি মাদকদ্রব্য ভারতে ব্যবহার এবং অবৈধ মাদক ব্যবহারের জন্য বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং মৃত্যু তদন্তে বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করেছে নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো। আত্মহত্যার সঙ্গে মাদকযোগের সম্পর্কের জেরে এই গ্রেফতার হলেও 'গাঁজা' কিংবা 'ভাঙ'-এর ব্যবহার ধর্মীয় উপলক্ষে হয়েই থাকে ভারতে। হোলি, শিবরাত্রির মতো উৎসবে 'ভাঙ' সেবন তো রীতিমতো নীতির মধ্যে পড়ে। ভারতের একাধিক অঞ্চলে এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়। রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতারে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত যে বিষয়গুলি উঠে আসছে। সেগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক।
ভারতের সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক একাধিক ক্ষেত্রে এর উপস্থিতি কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট। হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবকে তো 'ভাঙের প্রভু' হিসেবেও দেখা হয়। ইতিহাস জানায়, গাঁজার প্রধান উৎপত্তিস্থল ছিল মধ্য এশিয়ার উপত্যকাতে। মনে করা হয় দু'হাজার থেকে এক হাজার খ্রিষ্টপূর্ব আগে ভারতে তা আনা হয়েছিল। ভূগোলবিদ বার্নি ওয়ার্ফ তাঁর গবেষণা পত্র ‘হাই পয়েন্টস: অ্যান হিস্টোরিকাল জিওগ্রাফি অফ ক্যানাবিস’ পত্রিকায় লিখেছেন যে সম্ভবত আর্য আগ্রাসনের সময়কালে উদ্ভিদটি ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল।
তবে প্রথম থেকেই এই উদ্ভিদটিকে ঔষধি ক্ষেত্রে এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করার চল শুরু হয়। ভূগোলবিদ তাঁর বইতে এও লেখেন যে গাঁজার চাষ এবং সেবন সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় কৃষকরা প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতেন যাকে 'গাঁজা ডাক্তার' নাম দেওয়া হয়েছিল।
গাঁজার ঔষধি ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যেমন অথর্ব বেদে অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য এবং ভূতদের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে লড়াইয়ের গাঁজার ব্যবহারের প্রশংসা করা হয়েছে। বেদের একটি স্তবক অধ্যাপক মার্কএস ফেরারার তাঁর বই ‘পবিত্র পরমানন্দ: গাঁজার আধ্যাত্মিক ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এমনকী প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র হিসেবে যে বইটিকে মান্যতা দেওয়া হয় সেই 'সুশ্রুত সংহিতা' বইতেও গাঁজার ঔষধি গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে বলেই জানিয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে বেদে শিব এবং গাঁজার মধ্যে এক সম্পর্কও স্থাপন করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী থিওডর এম গডলস্কি তাঁর প্রকাশিত বই, 'শিভা, লর্ড অফ ভাঙ' বইটিতে বলেছেন, "শিব যখন মন্দার পর্বতের শিখর দিয়ে সমুদ্রকে আলোড়িত করেছিলেন, তখন এক ফোঁটা অমৃত আকাশ থেকে পড়েছিল। সেই অমৃত যেখানে পরেছিল সেখানে প্রথম গাঁজার গাছের জন্ম হয়। শিব মানবজাতির সুবিধার্থে গাছটিকে মন্দার পর্বত থেকে নামিয়ে আনলেন সমতলে।" বইটিতে গাঁজা সেবনের নিয়মও উল্লেখ করা রয়েছে এবং তা ধর্মীয় ভিত্তিতেই। শিবকে উৎসর্গ করেই এই উদ্ভিদ সেবন করেন ভক্তরা। কুম্ভমেলা, গঙ্গাসাগর মেলা, শিবরাত্রিতে ভাঙ এবং গাঁজা সেবন ধর্মীয় নীতির মধ্যেই রাখা হয়।
তাহলে গাঁজা সেবনে অপরাধ কোথায়?
ভারতে প্রাচীনকাল থেকে এর ব্যবহার হয়ে আসলেও 'নজরে' আসে ইউরোপীয়দের এদেশে পদার্পণের পর। ষোড়শ শতাব্দীর পর্তুগিজ কাহিনীকার গার্সিয়া দ্য অর্টা ভাঙ এবং মদ্যপানের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে লেখেন যে "আমি বিশ্বাস করি যে এটি খুব সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। এত সংখ্যক লোক এটি ব্যবহার করে যে এখানে কোনও রহস্য নেই।"
যদিও ১৭৯৮ সালে গাঁজা, ভাঙ এবং চরস ব্যবহারের উপর শুল্ক বসানোর জন্য আইন পাস করা হয়। এরপরও এই সকল দ্রব্যগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য একাধিক চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার। বর্তমানে ভাঙকে এই তালিকা থেকে বাদ দিলেও চরস এবং গাঁজাকে অবৈধ এবং অপরাধমূলক কাজ হিসেবেই দেখা হয় আইনের চোখে।
২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় ভারতে ৭২ লক্ষ মানুষ গাঁজা সেবন করেন। এমনকী সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এনজিও এবং তাদের কর্মী গোষ্ঠীগুলি সক্রিয়ভাবে দেশে গাঁজা বৈধকরণের জন্য প্রচারও চালাচ্ছে।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন