নির্বাচন কমিশনারদের পিএমও-র বৈঠকে ডেকে পাঠানো ইস্যুতে সরগরম জাতীয় রাজনীতির সড়ক। এটা কমিশনের স্বাধিকার খর্বের তোপধ্বনি, বলছেন অনেকে। এর আগেও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন সহ নানা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা-পরিসরে মাথা গলানোর অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। এ ব্যাপারে তাদের সৎ থাকার দায়বদ্ধতা রয়েছে। যদিও দুইয়ের মধ্যে চিনের প্রাচীর, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের তরফে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ কারণে চিঠি লিখতে দেখা গিয়েছে। ১৯৯৯ সালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এমএস গিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে চিঠি লিখে অভিন্ন ভোটার তালিকা সহ নির্বাচনী সংস্কারের প্রস্তাব করেন। আবার, ২০১৬ সালে সিইসি নাসিম জাইদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে ভিভিপ্যাট কেনার জন্য বরাদ্দ থাকা অর্থ চেয়েছিলেন।
কিন্তু তিন নির্বাচন কমিশারকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রধান সচিবের ডেকে পাঠানোর যে খবর, যার জেরে নতুন করে কমিশনের স্বাধিকারে সরকারি প্রভাবের যে অভিযোগ, তার কোনও উদাহরণ অতীত থেকে খুঁজে বার করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞদের অনেকে। নির্বাচন কমিশনের কাজের যে স্বাধীন পরিধি, তার মধ্যে সরকারের কোনও রকম হস্তক্ষেপ কাম্য নয়, কমিশনের নিরপেক্ষতার ছবিটা অটুট রাখার জন্য এটা অতি জরুরি। কারণ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন পরিচালনার বিরাট দায়িত্ব রয়েছে কমিশনের ঘাড়ে। বলছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র বলছে, আইন মন্ত্রকের তরফে কমিশনকে লেখা ওই চিঠি, যার ভাষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সচিব আশা করছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের এক প্রাক্তন আধিকারিকের কথায়, সরকারের কেউ, তা তিনি যতই উচ্চ কোটির আমলা বা মন্ত্রী হোন না কেন, মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে আলোচনায় উপস্থিত থাকার জন্য বলতে পারেন না।
জানা গিয়েছে, আইন মন্ত্রকের তরফে লেখা এই চিঠির ভাষায় অসন্তুষ্ট সিইসি। এবং ভিডিও বৈঠকটিতে তিনি হাজিরও থাকেননি। তাঁর বদলে কমিশনের অফিসাররা তাতে ছিলেন। তবে সেই বৈঠকের পর মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র এবং আরও দুই নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার এবং অনুপকুমার পাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিবের সঙ্গে ভার্চুয়ালে আলোচনা করেন, যে বৈঠককে 'ইনফরমাল' বলা হলেও, এর কড়া সমালোচনা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এতে নির্বচন কমিশনের ইমেজে যে ক্ষতের সৃষ্টি হল, তা সহজে সারবে না। অভিন্ন ভোটার তালিকা নিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের ওই বৈঠক সম্পর্কে শনিবার আইন মন্ত্রকের তরফে বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। তারা গোটা বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে। বলেছে, কমিশনের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক বা প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকার জন্যই চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই বৈঠকের পর তিন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব পি কে মিশ্রের আলোচনাকে ইনফরমাল তারা বলেছে বিবৃতিতেই।
কমিশনের স্বাধীনতায় সরকারের ছায়া পড়ার অভিযোগ গুরুতর হলেও পুরনো, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে সেইটি বলা যেতে পারে। ১৯৯৫ সালের ওই মামলাটি ছিল, টি এন সেশন বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের। রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক যে, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কোনও প্রতিষ্ঠানের উপর ক্ষমতাসীন দল কিংবা সরকারের আধিকারিকদের কোনও প্রভাব থাকবে না। নির্বাচন কমিশন এই লক্ষ্যেই গঠিত। সংবিধানের ধারা ৩২৪ (১) অনুযায়ী এই কমিশন একটি 'পার্মান্যান্ট বডি'।
আরও পড়ুন হেরিটেজের হিরের হার কলকাতার দুর্গার গলায়, কেন?
সাম্প্রতিক কালে, বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে কমিশনের স্বাধিকার বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের দিনক্ষণ প্রকাশের পর, নির্ঘণ্টে তীব্র আপত্তি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্জন করেছিলেন কমিশনের বিরুদ্ধে। বলেন, নির্বাচন কমিশন চলছে বিজেপির কথায়।
২০১৭ সালে বিজেপিকে সুবিধা দিতে গুজরাতের ভোটে দেরি করা হচ্ছে, এমন সমালোচনায় জেরবার হয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তখন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন অচলকুমার জ্যোতি। হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাতের ভোটের দিনক্ষণ একসঙ্গে জানানোর কথা থাকলেও, হিমাচলের-টি হল, কিন্তু গুজরাতের ঘোষণা হল না। বিরোধীরা বললেন, ফাউল! 'বড় প্রকল্প ঘোষণার জন্যই গুজরাতের বিজেপি সরকারকে সময় দিল কমিশন।'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন