চাঁদে মহাকাশযান অবতরণ করানোর প্রথম ভারতীয় প্রচেষ্টা সফল হয়নি। চন্দ্রযান ২-এর ল্যান্ডার অংশ, যার নাম বিক্রম - সে তাঁদের পিঠে নামার সময়ে গতিবেগ প্রত্যাশানুযায়ী কমাতে পারেনি, এবং সম্ভবত নিরাপদে অবতরণের জন্য যতটা গতি প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে বেশি গতিতে চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়েছে সে। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের সঙ্গে ল্যান্ডারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল চাঁদ থেকে মাত্র ২.১ কিলোমিটার দূরে।
রবিবার ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিভন জানিয়েছেন ল্যান্ডারটিকে চাঁদের উপর দেখতে পাওয়া গিয়েছে এবং চন্দ্রযান ২-এর অরবিটারের যন্ত্রপাতি দিয়ে তার থার্মাল ইমেজও তোলা গিয়েছে। শিভন অবশ্য এও জানিয়েছিলেন যে ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা এখনও সফল হয়নি।
তাহলে কি চন্দ্রযান ২ ব্যর্থ?
চাঁদে মহাকাশযান অবতরণের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও মিশন ব্যর্থ হয়নি। এই মিশনে ছিল একটি অরবিটার, একটি ল্যান্ডার ও একটি রোভার। অরবিটার অংশটি যথাযথভাবে কাজ করেছে। এ মিশনের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানগুলির অধিকাংশই অরবিটারের যন্ত্রপাতিগুলি দিয়েই পরিচালিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদে জলের সন্ধান করাও। ল্যান্ডার ও রোভারের মিশনের মেয়াদকাল ছিল মাত্র ১৪ দিনের, অন্যদিকে অরবিটার কাজ করবে অন্তত এক বছর ধরে। বৈজ্ঞানিকেরা দাবি করছেন, মিশনের বৈজ্ঞানিক যে সব ফলাফল- তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসবে অরবিটার থেকে, যা একেবারেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
বিক্রম কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে?
আরও পড়ুন, চন্দ্রযান’২ এর পর সৌরজগতের রহস্য উদঘাটনে ইসরোকে সাহায্য করবে নাসা
এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। যখন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তখন বিক্রমের গতি ছিল ৫০ থেকে ৬০ মিটার প্রতি সেকেন্ড। তখন তার গতি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে হ্রাসমানতার গতি এত বেশি ছিল না যাতে নিরাপদ অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতি সেকেন্ডে ২ মিটার গতিতে তা নেমে আসতে পারে। প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিটার পর্যন্ত গতিতে অবতরণ করলেও যে ধাক্কা লাগত তা সহ্য করার ক্ষমতা বিক্রমের ছিল, কিন্তু বিক্রমের গতি অত কম হয়নি। সম্ভবত চাঁদে বিক্রম এর চেয়ে বেশি গতিতে আছড়ে পড়েছে, যার ফলে বিক্রমের নিজের এবং তার অভ্যন্তরস্থ যন্ত্রপাতিরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তাহলে ইসরো এখনও যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেন?
তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিজ্ঞান এটা ধরে নিতে পারে না যে ল্যান্ডারটি ধ্বংস হয়েছে। বিজ্ঞানকে তা নিশ্চিত করতে হবে, এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আঁচ করতে হবে। কী ঘটেছে আর কেনই বা ঘটেছে, তা জানার প্রথম ধাপ ল্যান্ডারটিকে খুঁজে বের করা এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা।
এমনটা কি সম্ভব?
ল্যান্ডারের খোঁজ ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত পথ থেকে ল্যান্ডার যখন বিচ্যুত হয় তখন চাঁদ থেকে তার দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েক কিলোমিটার। ফলে ল্যান্ডার যেখানেই অবতরণ করুক না কেন, তা নির্ধারিত স্থানের চেয়ে কয়েক কিলোমিটারের বেশি দূরে হতে পারে না। ইসরো ল্যান্ডারের খোঁজ পেয়েছে অরবিটারের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। অরবিটার কেবলমাত্র থার্মাল ইমেজ নিতে পেরেছে, তার সম্ভাব্য কারণ হল যে সময় অরবিটার ওই এলাকার উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন যথেষ্ট পরিমাণ সূর্যালোক ছিল না- ফলে সাধারণ ফোটো তোলা সম্ভব হত না।
কঠিনতর কাজ হল ল্যান্ডারের সঙ্গে ফের যোগাযোগ স্থাপন করা। সেটা নির্ভর করবে ল্যান্ডারের কতটা ক্ষতি হয়েছে এবং ল্যান্ডারের যোগাযোগ যন্ত্র অটুট রয়েছে কিনা তার উপর। ল্যান্ডারে এমন সব যন্ত্র রয়েছে যার মাধ্যমে সে সিগন্যাল পাঠাতে পারে যে সিগন্যাল কাছাকাছির কোনও মহাকাশ যন্ত্র বা গ্রাউন্ড স্টেশনে ধরা পড়তে পারে। সেরকম প্রতিটি সিগন্যালই অতীব মূল্যবান ক্লু হয়ে উঠতে পারে, যার মাধ্যমে ল্যান্ডারের বর্তমান অবস্থা টের পাওয়া যেতে পারে এবং ল্যান্ডার কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তাও বোঝা যেতে পারে।
যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে। তারপর চাঁদে রাত নামবে (পৃথিবীর হিসাবে ১৪ দিনের জন্য) যে সময়ে ঠান্ডা এত বেশি হবে যে যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করবে না।
এখন তাহলে সবেচেয়ে ভাল কী হতে পারে?
ল্যান্ডারের কিছু যন্ত্রাংশ কাজ করছে এমন একটা সম্ভাবনা আছে। এমন সম্ভাবনাও রয়েছে যে গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে ল্যান্ডারের দ্বিপাক্ষিক সংযোগ হল এবং ল্যান্ডার কাজ করতে শুরু করল। এমনটাও ভাবা যেতে পারে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি যেমনবাবে কাজ করার কথা ছিল তেমনভাবে কাজ করতে শুরু করে দিল। ল্যান্ডারের কাজ ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠে অবস্থান করে তার চারদিকের চারটি যন্ত্রাংশের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা এবং তথ্য সংগ্রহ করা। এখন যা অবস্থা তাতে ল্যান্ডারের পক্ষে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়, যেমনটা তার থাকার কথা ছিল। যন্ত্রাংশ যদি কাজ করতে শুরু করে তাহলে তারা রিডিং নিতে পারবে এবং গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
আরও পড়ুন, চন্দ্রযান-২ অসফল, এসএলভি-৩ ব্যর্থতার পর কী বলেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কালাম
এর মধ্যে একটি যন্ত্র হল নাসার তৈরি করা লেসার রেট্রোরিফ্লেক্টর অ্যারে- যা আসলে একগুচ্ছ আয়না। এর নির্ধারিত কাজ ছিল চাঁদে অবস্থান করা- আর কিচ্ছু নয়। পৃথিবীতে অবস্থিত কন্ট্রোল স্টেশনগুলির চাঁদ থেকে প্রতিফলিত সিগন্যাল পায় এই আয়নাগুলির মাধ্যমে। এর আগের বিভিন্ন মিশনের মাধ্যমে চাঁদে অন্তত এরকম পাঁচটি আয়না পাঠানো হয়েছে। এদের কাজ নানা ধরনের। এই আয়নাগুলির মাধ্যমে পাঠানো সিগন্যালের মাধ্যমে চাঁদের থেকে পৃথিবীর দূরত্ব অতি নির্ভুলভাবে বিবেচনা করা হয়। চাঁদে আগে পাঠানো সব আয়নাগুলিই রয়েছে নিরক্ষীয় অঞ্চলে। বিক্রম ল্যান্ডারের মাধ্যমে এই প্রথম আয়না পাঠানো হয়েছিল চাঁদের মেরু অঞ্চলে। যদি এ যন্ত্রাংশ সম্পূর্ণ নষ্ট না হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তা ফের কাজে লাগতে পারে। অন্যদিকে ল্যান্ডার যদি খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে, তখনই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারত রোভার। কিন্তু রোভার এবং তার দুটি যন্ত্রাংশ এ অবস্থায় কাজ করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ইসরোর পক্ষে এ ব্যর্থতা কত বড়?
ইসরো সহ অন্যান্য মহাকাশ সংস্থা মহাকাশ গবেষণায় এ ধরনের অনেক ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এটা একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে। ২০০৮ সালে চন্দ্রযান ১-ও আংশিক ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। তার মেয়াদ ছিল ২ বছরের কিন্তু তা কার্যকর ছিল খুব বেশি হলে ৯ মাস। চাঁদের ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কক্ষপথ ছিল চন্দ্রযান ১-এর জন্য নির্দিষ্ট। সেখানে পৌঁছনোর ৮ মাস কাটতে না কাটতেই, ২০০৯ সালের মে মাসে, চন্দ্রযান ১-কে নিয়ে আসতে হয় ২০০ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে। কয়েক মাস পরে, সেটি মৃতপ্রায় মহাকাশযান হয়ে দাঁড়ায়। এখনও সেটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, কিন্তু তার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনও যোগাযোগ নেই।
তবে ততদিনে চন্দ্রযান ১-এর মূল বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গিয়েছিল। চাঁদে জলের হদিশের অকাট্য প্রমাণ হাজির করে দিয়েছিলে চন্দ্রযান ১, যা গবেষণার দিক থেকে এক ব্লকবাস্টার বলা চলে।
ল্যান্ডারের যাই হোক না কেন, চন্দ্রযান ২ মিশন উদ্ভূত বিজ্ঞানের উপর তার কোনও প্রভাব পড়বে না। তবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ নিয়ে যে হাইপ তৈরি হয়েছিল, তার ফলে ল্যান্ডারের ব্যর্থতা মানুষ খুব সহজে ভুলতেও পারবেন না। তবে ইসরো এ অভিযান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বহু কিছু শিখেছে, যা পরবর্তী মিশনে কাজে লাগবে।
Read the Full Story in English