২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যে লালগড় আন্দোলন বুদ্ধদেব সরকারের চরম মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল, তারই মুখ ছিলেন ছত্রধর মাহাত। জনসাধারণের কমিটির প্রধান নেতার সেই আন্দোলনের পিছনে সে সময় মাওবাদীদের মদত ছিল বলেও জানা যায়। তৃণমূল শাসিত বাংলা তিনি সেভাবে দেখেননি। তিনি যখন কারাবন্দি হয়েছিলেন তখন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। ১১ বছর কারারুদ্ধ থাকার পর মাত্র মাস কয়েক আগে তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। আর ছাড়া পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই রাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের কমিটিতে মিলেছে ঠাঁই। আগামী বছরের কঠিন নির্বাচনী লড়াইয়ের আগে রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বেহাত হয়ে যাওয়া জঙ্গলমহলে ফের জোড়াফুল ফোটানোর গুরু দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে ন্যস্ত করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলে ছত্রধরের এই পদপ্রাপ্তিই তাঁকে বহু বছর পর ফের আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিয়েছে। এ সময় একবার ফিরে দেখা যাক ছত্রধরের অতীত। কে তিনি? কেন তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা?
বুদ্ধদেবের কনভয়ে হামলা ও পরবর্তী পুলিশি সক্রিয়তা
২ নভেম্বর, ২০০৮। পপশঅচিম মেদিনীপুরের শালবনিতে একটি বেসরকারি ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাশ করতে যাচ্ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাশ পাসওয়ান এবং জিতিন প্রসাদ। এ সময়েই ঘটে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়।
এরপরই বিস্ফোরণের তদন্ত করতে মাওবাদী অধ্যুষিত লালগড় এলাকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে পুলিশ। সে সময় সাধারণ আদিবাসী জনতার উপর পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগও উঠতে শুরু করে। বিস্ফোরণের ঘটনার ঠিক দু'দিন পর অর্থাৎ ৪ নভেম্বর মাওবাদী সন্দেহে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে পাঠরত তিন স্কুল ছাত্রকে মাওবাদী সন্দেহে গ্রেফতার করে লালগড় পুলিশ।
পুলিশের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের নির্যাতনের অভিযোগ ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় 'পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি'। ক্রমে এই জনসাধরণের কমিটিকে পিছন থেকে পরিচালনা করতে থাকে মাওবাদীরা, এমনটাই দাবি। ছত্রধরের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিই ২০০৮-২০০৯ সালে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসীদের আন্দোলনে সংঘবদ্ধ করেছিল। আর ছত্রধরের ভাই শশধর ছিলেন মাওবাদী নেতা এবং ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত।
ছত্রধরের উত্থান এবং লালগড় আন্দোলন
ছত্রধরের নেতৃত্বে জনসাধারণের কমিটি সে সময় রাস্তা অবরোধ, রাস্তা কাটার মাধ্যমে এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুলিশকে প্রবেশ করতে দেয়নি। ঝাড়গ্রাম-বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুর জুড়ে যে বিস্তীর্ণ এলাকা তখন অনেকাংশে মাওবাদী নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল সেখানে সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের উপর আক্রমণ এবং রক্তপাতের খবর আসত নিয়মিত। এই আন্দোলন কিছু ক্ষ্ত্রে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির জনসাধারণের সমর্থন পাওয়ায় তা বড় রকমের ভাঁজ ফেলেছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কপালে।
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার বিরোধী জনসাধারণের কমিটির এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন প্রকাশ্যে এবং তাঁকে ছত্রধর মাহতোর সঙ্গে একই মঞ্চে দেখাও গিয়েছে।
২০০৮ থেকে এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বড় রকমের ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। বাংলার ৪২টি আসনের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেসের জোট প্রার্থীরা। তবে সেবার লালগড় আসনটি নিজেদের ঝুলিতেই রেখেছিল বামেরা। তবে লালগড়ে সেবার বামেরা জিতলেও সেখানকার বহু পার্টি অফিস এবং নেতাদের বাড়ি দখল হয়ে যায়। বহু বাম নেতাকে হত্যার অভিযোগও সামনে আসে।
আরও পড়ুন- আমি নিশ্চিত তৃণমূল কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরবে, দায়িত্ব পেয়ে প্রত্যয়ী ছত্রধর
লোকসভা ভোট মেটার একমাস পর অর্থাৎ ২০০৯ সালের ১৮ জুন 'অপারেশন লালগড়' শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। এই এলাকাকে নকশাল মুক্ত করতে অপারেশনে সাহায্য করে সিআরপিএফ, কোবরা, বিএসএফ-এর মতো কেন্দ্রীয় বাহিনীগুলিও। এই অপারেশন চতুর্থ দিনে গড়াতেই লালগড়ে ছুটে যান অপর্ণা সেন, শাঁওলি মিত্রের মতো খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। তাঁরা কমিটি এবং সরকার উভয় পক্ষকেই অস্ত্র ত্যাগ করে সমঝোতার রাস্তায় হাঁটার অনুরোধ করেন।
এই অপারেশনের ১২ দিনের মাথায় লালগড় 'পুনরুদ্ধার' করে পুলিশ। ছত্রধর-সহ অন্যান্য প্রতিবাদীরা আত্মগোপন করেন। এরপরই সরকারি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে 'সিধু-কানু গণ মিলিশায়া' নামক সামরিক শাখা খোলে 'পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি'।
জানা যায়, এই আদিবাসী আন্দোলনে ৪০০ সিপিআই(এম) নেতা-কর্মী, ৩০ পুলিশকর্মী এবং ১৮ জন মাওবাদীর মৃত্যু হয়।
ছত্রধরের পতন
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সাংবাদিকের ছদ্মবেশে সাক্ষাৎকার নেওয়ার অছিলায় ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের হয়। এরপরই মাওবাদীদের নেতৃত্বে জনগণের কমিটির সদস্যরা নয়া দিল্লিগামী ভূবনেশ্বর রাজধানী এক্সপ্রেসকে আটকে ছত্রধরের মুক্তি দাবি করে। সিআরপিএফ-রাজ্যপুলিশের তাড়া খেয়ে এরপর তাঁরা পালায়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১১ বছর আগের এই ঘটনার তদন্তভার দিয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থাকে (এনআইএ)।
২০১১ সালের মার্চ মাসে এক 'এনকাউন্টারে' মৃত্যু হয় ছত্রধরের ভাই শশধর মাহতোর। ২০১১ সালে পরিবর্তনের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে সংশোধনাগার থেকেই ভোটে লড়েন ছত্রধর। তবে মাত্র ২০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
২০১১ সালে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পর ছত্রধর এবং জনসাধারণের কমিটির সঙ্গে মোটের উপর দূরত্বই রেখে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বরং জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী কার্যকলাপ দমনে অতিসক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে তৃণমূল সরকার। এই আমলেই ২০১১ সালের নভেম্বরে পশ্চিম মেদিনীপুরের বুড়িশোলের জঙ্গলে 'এনকাউন্টারে' নিহত হন সিপিআই(মাওবাদী) দলের পলিটব্যুরো সদস্য কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি।
ভুয়ো সংঘর্ষে কিষেণজির মৃত্যু হয়েছে বলে পরবর্তী কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করেছিলেন ছত্রধর। তবে কিষেণজির মৃত্যুর পরই জঙ্গলমহল জুড়ে মাওবাদী কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা হাইকোর্ট ছত্রধর মাহাতো-সহ ৯ জনকে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা দেয়। এরপর ওই বছরই ১৫ মে ছত্রধর মাহাতো, সুখশান্তি বাস্কে, শম্ভু সোরেন এবং সাগুন মুর্মুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
জঙ্গলমহলে গেরুয়া ঝড়
১৯৭৭ সালে বাংলায় ক্ষমতায় এসে ভূমি সংস্কার করেছিল জ্যোতি বসুর সরকার। এ সময়ই জঙ্গল মহলের সাধারণ গ্রামবাসীরা জমির অধিকার পান। সেই শুরু। তখন থেকে একটানা ২০১৪ সাল পর্যন্ত লালগড়-সহ জঙ্গলমহলের রঙ থেকেছে লালে লাল।
২০১৪ সালে ৩৭ বছরের এই পরম্পরায় ছেদ ঘটায় তৃণমূল। লালগড়-সহ জঙ্গলমহলের অধিকাংশ আসনেই জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থীরা। ২০১৭ সালে মমতা সরকার উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে ঝাড়গ্রামকে পৃথক জেলা হিসাবে স্বীকৃতিও দেন। তবু স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের (সাংসদ সহ) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সন্ত্রাস অনেকাংশে তৃণূলের থেকে বিমুখ করে জনগণকে।
একদা তৃণমূল যা করেছিল ঠিক এই সুযোগে সেটাই করে বিজেপি। ক্ষতিগ্রস্থ এবং বিক্ষুব্ধদের কাছে যায় এবং তৃণমূল সরকার কীভাবে কেন্দ্রের মোদী সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প না নিয়ে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে তা বোঝায়। ফলও মেলে হাতেহাতে, শুধু লালগড়ই নয় জঙ্গলমহলের ছয়টির মধ্যে পাঁচটি আসনই জিতে নেয় বিজেপি। এই এলাকায় বিজেপির এমন উল্কা সদৃশ উত্থানই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তৃণমূলের। আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে তাই হারিয়ে যাওয়া জঙ্গলমহলের জমি ফিরে পেতে মরিয়া মমতা বাহিনী।
ছত্রধরেই ফের আস্থা
ছত্রধরের প্যারোল মঞ্জুরির বিরোধিতা করেনি মমতা সরকার। বরং তাঁকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ১১ বছরের কারাবাসের পর চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পেয়েছেন। ছত্রধরের পুত্র ধৃতিপ্রসাদকে লালগড়ের সমবায় ব্যাঙ্কে গ্রুপ-ডি পদে চাকরিও দেওয়া হয়েছে। এরপরই 'এলাকায় শান্তি ফেরাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ' তৃণমূলে যোগ গিয়েছেন একদা জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর।
২০২১ সালের কঠিন নির্বাচনী লড়াইয়ের আগে জঙ্গলমহলে দলের মঙ্গলের জন্য ছত্রধরেই আস্থা রেখেছেন মমতা। তৃণমূল সূত্রে খবর, তৃণমূল স্তরে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একদা মমতাকে কিষেণজি হত্যায় দায়ী করা ছত্রধরকে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন