চিনের সেনাবাহিনী ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর তিব্বতের পথে অগ্রসর হয়। সেই সময় বেশিরভাগ তিব্বতি এই আক্রমণের কথা ভাবতেই পারেননি। দাওয়া নরবু, সেই সময়ে শিশু। ১৯৭৮ সালে ওয়ার্ল্ড ভিউ ম্যাগাজিনে তিনি লেখেন, '১৯৫০ সালের চিনা আগ্রাসনের খবর আমাদের কাছে ১৯৫২ সালের কোনও একসময়ে এসে পৌঁছেছিল।' ১৯৫০ সালে তিব্বত এমনই ছিল। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে নরবু লিখেছেন, 'পৃথিবীর ছাদে আধুনিকতার আশীর্বাদ এবং বাধা উভয় থেকেই দূরে (তিব্বত) ছিল একটি প্রত্যন্ত ভূমি। ধীরে ধীরে চিনা আগ্রাসনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উদ্বেগ ছড়ায় আরও ধীরে। আতঙ্কজনক খবর সত্ত্বেও শাক্যতে কেউ তাঁর তরবারি ধারালো করেননি। তাঁর ধনুক এবং তির ব্যবহারও করেননি।' শাক্যের বাসিন্দারা কল্পনাও করেননি যে চিনের আক্রমণ একটি স্থায়ী দখলদারি হয়ে উঠবে। যা তিব্বতকে চিরতরে বদলে দেবে। চিনের সেই আক্রমণের এবছর ৭৩তম বর্ষ।
তিব্বত দখলের জন্য চিনের প্রেরণা
গত ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর, গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের ঘোষণার আগেই চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) তিব্বতের সংযুক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এর পিছনে আদর্শগত এবং বাস্তববাদী দুই ধরনের কারণই ছিল। কমিউনিস্টরা চিনের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাড়াতে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তিব্বতে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। আদর্শগতভাবে, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য তিব্বত ছিল সামন্ত-ধর্মতন্ত্র। যা থেকে তারা জনগণকে 'মুক্তি' দিতে চেয়েছিল। এছাড়াও, ইতিহাসের অনুপ্রেরণা থেকেও চিন তিব্বত অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কারণ, তিব্বত সর্বদাই চিনের অংশ ছিল।
তিব্বত কার্যত স্বাধীন ছিল
নতুন শক্তিশালী চিনা রাষ্ট্রের জন্য, তিব্বতের অন্তর্ভুক্তি তাই ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, তিব্বতের ইতিহাস বলে যে, তা কখনও পুরোপুরি চিনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তিব্বত ঐতিহাসিকভাবে চিনা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ১৯৫০ সালের আগে থেকে তা স্বাধীন ছিল। যার নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্ম ছিল। এমনকি ১৭২০ সালে যখন কিং রাজবংশ তিব্বতের ওপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, সেই সময়ও তিব্বতিরা সরাসরি চিনের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তই ছিল। ১৯১১ সালে কিং শাসনের অবসানের পর, তিব্বত এক দ্বৈতশাসনে থাকা কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কীভাবে কমিউনিস্ট আক্রমণ হয়েছে
১৯৪৯-৫০ সাল, এই সময়টায় লাসা (তিব্বতের রাজধানী) এবং বেজিং (চিনের রাজধানী)-র মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলেছিল। চিন তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছিল: ১) তিব্বতকে চিনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হোক, ২) তিব্বতের প্রতিরক্ষার জন্য চিন দায়ী থাকবে এবং ৩) তিব্বতের বাণিজ্য ও বৈদেশিক সম্পর্কের জন্য চিন দায়ী থাকবে। এরপরই, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) তিব্বতের পূর্ব সীমান্তে স্থায়ী বাহিনী রেখে দেয়। চিন চেয়েছিল, এভাবে ভয় দেখিয়ে তিব্বতকে হাতজোড় করতে বাধ্য করতে। তিব্বতের একটি ছোট সেনাবাহিনী ছিল। তারা গোটা ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। চিনের বাহিনীর কাছে তাদের ক্ষমতা প্রায় কিছুই ছিল না, বললেই চলে।
আরও পড়ুন- শক্তিধর ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে তছনছ করেছে, গাজার শাসক, কী এই হামাস?
তিব্বতের সেনা পরাজিত
তিব্বতের সীমানাতেও বহু ফাঁক ছিল। এর জনসংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট এবং বিভিন্ন এলাকায় ছড়ানো। চিনের আক্রমণের ক্ষেত্রে, তিব্বত বিদেশি সমর্থন চেয়েও পায়নি। চিনের সেনা জিনশা (ইয়াংসি) নদী অতিক্রম করে এবং ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবরের প্রথম দিকে খাম প্রদেশে প্রবেশ করে। ১৯ অক্টোবরের মধ্যে, এই সেনা চামডো শহর দখল করে এবং সেখানে তিব্বতের বাহিনীকে পরাস্ত করে। যুদ্ধে কমপক্ষে ১৮০ জনের মৃত্যু হয়। ৩,০০০-এরও বেশি তিব্বতিকে বন্দি করা হয়েছিল। এর পরই চিন শত্রুতা বন্ধ করে দেয়। তারা চামদোর পরাজিত গভর্নর এনগাবো এনগাওয়াং জিগমেকে লাসায় দালাই লামার কাছে চিনের প্রস্তাব পুনরায় বিবেচনা করতে পাঠায়। সেই সময় দালাই লামার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।
তিব্বতকে চিনারা পরাধীন হতে বাধ্য করেছিল
১৯৫১ সালের মে মাসে, প্রচণ্ড চাপের মধ্যে, তিব্বতের শাসকরা চিনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছিল। যার নাম সপ্তদশ দফা চুক্তি। এই চুক্তি কার্যকরভাবে তিব্বতকে চিনের অধীনস্ত করে। চিনের সেনাকে তিব্বতের মধ্যে প্রবেশের অনুমতি দেয়। সমস্ত আন্তর্জাতিক বিষয়ে বেজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে বাধ্য করে। একইসঙ্গে চিনকে আর্থিক 'সংস্কার' করারও অনুমতি দেয়। সেই সময় চিন, তিব্বতে স্থানীয় প্রশাসন, তিব্বতি সংস্কৃতি এবং ধর্মে হস্তক্ষেপ না-করার আশ্বাস দেয়। চুক্তির তৃতীয় পয়েন্টে বলা হয়েছে, 'কেন্দ্রীয় জনগণের সরকারের নেতৃত্বে তিব্বতের জনসাধারণের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার অধিকার আছে।' কিন্তু চুক্তির কালির দাগ শুকানোর আগেই চিনারা তা লঙ্ঘন করতে শুরু করে। তিব্বতজুড়ে পিএলএ-র উপস্থিতি সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে হুমকির ব্যাপার হয়ে ওঠে। তিব্বতে চিনা হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পায়। একটু একটু করে, এটি তিব্বতি প্রশাসন স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ফেলে এবং শীঘ্রই খাম এবং আমদোতে বড় আকারের কমিউনিস্ট 'সংস্কার' কার্যকর করা হয়।
জাতীয় বিদ্রোহ এবং দালাই লামার নির্বাসন
১৯৫৪ সাল নাগাদ, তিব্বতে প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। কারণ চিনারা মঠ ধ্বংস করতে শুরু করে এবং সমষ্টিকরণের নীতি চাপিয়ে দেয়। তিব্বতি জীবনের সমস্ত দিক, স্কুল থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে পর্যন্ত চিনারা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এছাড়াও লাসা এবং মধ্য তিব্বতে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে তিব্বতের পূর্বাঞ্চল থেকে উদ্বাস্তুরা আসতে থাকেন। কারণ, সংস্কারের প্রভাব সেখানে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। ১৯৫৯ সালের মার্চে তিব্বতের জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে। প্রথমবার লাসায় একটি বিদ্রোহ হয়। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি দালাই লামাকে গ্রেফতার করতে পারে, এমন আশঙ্কা দেখা দেয়। বিক্ষোভকারীরা লাসার রাস্তায় ভিড় করেন। আর, পিএলএ-র সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। চিন নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। ৮০ হাজারেরও বেশি তিব্বতি প্রাণ হারান। পিএলএ লাসায় অবিরাম গোলাবর্ষণ করে। যার জেরে অনেক সুন্দর মঠ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
দলাই লামা পালিয়ে আসেন
২৩ মার্চ, দালাই লামা লাসা থেকে পালিয়ে যান। আর কখনও ফিরে আসেননি। তাঁকে পালাতে সাহায্য করে ভারত। অসম রাইফেলসের জওয়ানরা তাঁকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসেন। কারণ লাসা শহরটি চিনারা দখল করে নিয়েছিল। তাঁকে যখন ভারতে নিয়ে আসা হয় (বর্তমান অরুণাচলের তাওয়াং), তরুণ দালাই লামা ১৭ দফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। নিজেকে তিব্বতের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর ১৯৫৯ সাল থেকে, তিব্বতের ওপর চিনের দখল হয় নিরঙ্কুশ। চিন সেখানে ভিন্নমতকে চূর্ণ করে। ধর্মীয় কেন্দ্রে তার নিজের লোকেদের বসায়। তিব্বতে চিনের হান বাসিন্দাদের যাতায়াত সহজ করে। এর জনসংখ্যাগত এবং সাংস্কৃতিক উভয় গঠনই পরিবর্তন করে।