Advertisment

পশ্চিম এশিয়া সফরে চিনের দূত: ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতে বেজিংয়ের উসকানি ঠিক কতটা?

চিন নিজেকে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন, উভয়ের বন্ধু বলে দাবি করেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Israeli Prime Minister Benjamin Netanyahu, left, and Chinese President Xi Jinping in Beijing, China in 2017. On right, Xi and Palestinian President Mahmoud Abbas in 2023.

২০১৭ সালে চিনের বেজিংয়ে বামদিকে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ডানদিকে, ২০২৩ সালে শি জিনপিং ও প্যালেস্তাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। (জেড গাও/এটিন অলিভেউ/এপির তোলা ছবি)

পশ্চিম এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত চিনের বিশেষ দূত ঝাই জুন, ইজরায়েল-হামাস সংঘাত ইস্যুতে আগামী সপ্তাহে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করবেন। রবিবার ১৫ অক্টোবর, এমনটাই জানিয়েছে চিনের সরকারি গণমাধ্যম সিজিটিএন। ঝাই বলেছেন যে তিনি, 'যুদ্ধবিরতি, সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষা, উত্তেজনা হ্রাস এবং শান্তি ইস্যুতে আলোচনার জন্য বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করবেন।'

Advertisment

ইজরায়েল হামাসের হামলার ব্যাপারে চিন এখনও পর্যন্ত কী বলেছে?

প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে আক্রমণ করেছে। তার কয়েকদিন পর, এখনও পর্যন্ত ১,৪০০ জনেরও বেশি ইজরায়েলি নিহত হয়েছেন। চিনের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র মাও নিং হামাসের উল্লেখ না-করেই 'সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি করে', এমন কাজের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমরা এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করি যা সংঘাত বাড়ায় এবং অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলে। আশা করি যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং শীঘ্রই শান্তি ফিরে আসবে। আমরা যা দেখতে চাই, তা হল দুটি দেশ ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন উভয়ের বন্ধু হিসেবে একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছে। এটি অর্জনের মূল চাবিকাঠি হল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্যালেস্তাইন প্রতিষ্ঠা।' ১৫ অক্টোবর চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া জানিয়েছে, চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং-ই সৌদি আরবের বিদেশমন্ত্রী ফয়জল বিন ফারহান আল সৌদকে ফোন করে বলেছেন যে, 'ইজরায়েলের পদক্ষেপগুলো আত্মরক্ষার বাইরে চলে গেছে এবং এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্ব তার বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব গাজার জনগণের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত শাস্তি বন্ধ করতে অনুরোধ করেছেন। ইজরায়েলের পালটা হামলায় প্যালেস্তাইনে ২,২০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন।'

আর প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার নিয়ে চিন কী বলেছে?

ওয়াং ই সৌদি মন্ত্রীকে ফোনে বলেছেন, 'চিন বিশ্বাস করে যে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অবিচার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলেছে। আর, এটা চলতে পারে না। চিন এই ব্যাপারে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। প্যালেস্তিনীয়দের তাদের জাতীয় অধিকার পুনরুদ্ধারের ন্যায়সঙ্গত কারণকে সমর্থন করা চালিয়ে যেতে হবে।' এক পৃথক বিবৃতিতে ওয়াং বলেছেন, 'প্যালেস্তাইনের প্রশ্নটি পশ্চিম এশিয়ার সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এমন একটি ক্ষত তৈরি করেছে, যা বর্তমান বিশ্বকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। ইজরায়েলেরও রাষ্ট্রত্বের অধিকার রয়েছে, প্যালেস্তাইনেরও রয়েছে। ইজরায়েলিদের বেঁচে থাকা এবং নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। কিন্তু, প্যালেস্তিনীয়দের বেঁচে থাকার চিন্তা করবে কে? ইহুদি জাতি পৃথিবীতে আর গৃহহীন নয়। কিন্তু, প্যালেস্তিনীয়রা কবে নিজেদের ঘরে ফিরবে? পৃথিবীতে অন্যায়ের অভাব নেই। কিন্তু, প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি অবিচার অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলছে।'

এই মন্তব্যগুলো কীভাবে পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল সম্পর্কে চিনের অবস্থান তুলে ধরেছে?

ঝাই জুনের সঙ্গে কথোপকথনে ইজরায়েলি কূটনীতিক রাফি হারপা চিনের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, চিনের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে পশ্চিম এশিয়ায় তার কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তার প্রাথমিক বিরোধিতা। কারণ, ইজরায়েল হল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে চিনের মন্তব্যগুলো প্যালেস্তাইনের প্রতি আরব বিশ্বের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছে। যার মাধ্যমে চিন এই অঞ্চলে তার মিত্রদের সমর্থনকেই সুরক্ষিত করতে চেয়েছে। আর, পশ্চিমী শক্তির বিরোধিতা করেছে। ইজরায়েল এবং অন্যান্য আরব দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা প্রায়শই হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। সেসব কথা মাথায় রেখে চিনও সমালোচনায় সরব হয়েছে। হামলার জন্য হামাসের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে।

চিন ও আরব দেশ

চিন তার কূটনৈতিক ব্যস্ততার মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চায়। ২০২৩ সালের মার্চে চিন আঞ্চলিক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে একটি স্বাভাবিককরণ চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০২৩ সালের জুনে প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের (পিএ) নেতা মাহমুদ আব্বাসকে আতিথেয়তা দিয়েছিল। চিন পিএ-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। পিএ পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা থেকে কাজ করে। পিএ প্যালেস্তাইন জনগণের প্রতিনিধি। আব্বাসের সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে চিন জানিয়েছে, প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন এবং প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে চিন প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৮ সালে চিন প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চিন বরাবরই প্যালেস্তাইনের জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার পুনরুদ্ধারের ন্যায়সঙ্গত কারণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে।

প্যালেস্তাইনের পালটা বক্তব্য

১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে জর্ডান, মিশর এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল ইজরায়েল। তারপর থেকে ইজরায়েল তাদের বসতি বাড়িয়েছে। পূর্ব জেরুজালেমকে প্যালেস্তাইনের রাজধানী হিসেবে চিন সমর্থন করেছে। প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি মানবিক সহায়তা বাড়িয়েছে। শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকেছে। চিন এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঘোষণার সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে আব্বাস বলেছেন, 'প্যালেস্তাইন চিনের প্রজ্ঞা ও ন্যায্য অবস্থানে বিশ্বাস করে এবং প্যালেস্তাইনের অভ্যন্তরীণ পুনর্মিলন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চিন আরও বেশি ভূমিকা পালন করবে, এমনটা প্রত্যাশা করে।' অর্থনৈতিক ফ্রন্টে, চিন আবার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অংশ হিসেবে পরিকাঠামো প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার ১৮টি দেশ বিআরআই-এর অংশ। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সৌদি আরবের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতাও চিন।

আরও পড়ুন- স্থলপথে ইজরায়েলের আক্রমণ আসন্ন, কী প্রভাব পড়েছে গাজা, হামাস এবং প্যালেস্তাইন আন্দোলনে?

চিন এবং ইজরায়েল

কিন্তু, এর মানে এই নয় যে চিন ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের বিরোধী। চিন ১৯৯২ সালেই ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ইজরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চিন-ইজরায়েল ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, পরিচ্ছন্ন শক্তি এবং অর্থের মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। ইজরায়েল এই সম্পর্ক বাড়ানোরও চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার, সেই চিনই প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে, ইজরায়েলও উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং অঞ্চলে চিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছে।

Israel-Palestine clash china West Asia
Advertisment