Advertisment

Explained: বিক্ষোভে ফুটছে চিন, মনে করাচ্ছে তিয়ানানমেন স্কোয়ারকে, কী ঘটেছিল তার আগে?

মাও জমানার বর্বরতা ঢাকতেই সংস্কারের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল চিন। কিন্তু, স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা চলেছিল এখনকার মতই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
President Xi

করোনাকে উপলক্ষ করে টানা লকডাউনের জেরে চিনে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এমন বিক্ষোভ চিনে আর দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার রাতে, পশ্চিম চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকির এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিনের কঠোর হোম আইসোলেশন নীতির জন্য লোকজন ওই অ্যাপার্টমেন্টে তালাবন্ধ ছিল। ঘটনার পর থেকে কোভিডের নামে জনগণের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা বন্ধের আহ্বান উঠেছে চিনজুড়ে। শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। যা ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকের প্রতিবাদকে মনে করাচ্ছে। যে বিক্ষোভ ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়ারে দমনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল।

Advertisment

মাওয়ের ক্ষমতা দখল
মাওবাদী নীতির ব্যর্থতা বা তিয়ানানমেন বিক্ষোভকে বোঝার জন্য অবশ্যই তার পূর্ববর্তী দশকগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সেই সময় কমিউনিস্ট শাসন বেশ কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। যা শেষ পর্যন্ত তাদের আদর্শ পূরণের লক্ষ্যে ব্যর্থ হয়েছিল। যাতে চিনা সমাজে অনেক গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়। কমিউনিস্টরা ১৯৪৯ সালে চিনে ক্ষমতায় আসে। বেজিংয়ের তিয়ানানমেন স্কোয়ার থেকে মাও নতুন চিনের জন্মের কথা ঘোষণা করেন। অনেকটা পূর্বের সোভিয়েতের মতই, সেই সময় চিন মার্কসবাদী ভাষায় বললে বিপ্লবের জন্য 'তৈরি ছিল না।'। এর অর্থনীতি ছিল মূলত সামন্তবাদী বা প্রোটো-পুঁজিবাদী। শিল্পভিত্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। আর সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাস্তরে বিভক্ত ছিল।

দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড

এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য মাও ১৯৫৮ সালে 'গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড' চালু করেন। যা ছিল, চিনের বিশাল জনসংখ্যাকে শিল্প ও কৃষির সমস্যা মেটাতে সংগঠিত করার জন্য একটি প্রচার। এই প্রচার জীবনযাত্রা এবং উত্পাদনের নানা পদ্ধতি তৈরির মাধ্যমে চলেছিল। বিশেষত, বড় গ্রামীণ কমিউন এবং সংগঠিত শহুরে কারখানার স্থানে (যেখানে গ্রামীণ চিন থেকে ব্যাপকহারে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়েছিল) চলেছিল। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের কেন্দ্রীয়স্তরের পরিকল্পনা অনুসারে নির্দিষ্ট পণ্য উত্পাদন ও বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কৃষি ব্যবস্থার দুর্বলতা, গণ-আন্দোলন এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উদ্ভূত জটিলতার জেরে ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালের মধ্যে বড় দুর্ভিক্ষের জেরে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা চিনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ও মাওয়ের ব্যক্তিগত অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

চিনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব

মাও মনে করেছিলেন যে 'গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড' নিয়ে ব্যর্থতা চিনে গভীরভাবে প্রোথিত ঐতিহ্যবাহী সমাজের কারণে ঘটেছে। যা বহু পুরোনো আনুগত্যের সঙ্গে জড়িত। আর, এর পিছনে রয়েছে একটি সংস্কৃতি। যা সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই, ১৯৬৬ সালে তিনি 'সাংস্কৃতিক বিপ্লব'কে গতিশীল করে আবারও বল ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। যার লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসারে সমাজকে রূপান্তরিত করা। সেই সঙ্গে স্টালিনবাদী শুদ্ধির মাধ্যমে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে মাওয়ের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। চেয়ারম্যান মাও চিনা তরুণদের তথাকথিত চার 'পুরাতন' বা চিনা সংস্কৃতির শত্রুদের ধ্বংস করার লাইসেন্স দিয়েছিলেন। মাওয়ের ভাবনা অনুযায়ী, এই চার শত্রু হল: রীতিনীতি, অভ্যাস, সংস্কৃতি এবং চিন্তাভাবনা।

আরও পড়ুন- রাহুলের ধারাবাহিকতার অভাব আছে, ‘ভারত জোড় যাত্রা’ নিয়ে নাম না-করে কটাক্ষ শাহর

বিপ্লবের নামে অশান্তি
প্রথমদিকে বিশৃঙ্খলা, অত্যাচার চলেছিল। স্কুল এবং মন্দির ধ্বংস করা হয়। পরস্পরের মধ্যে লড়াই করেছেন চিনের নাগরিকরা। 'বিপ্লবের শত্রু'দের মারধর করা হয়। বন্দি করা হয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং নির্বাসিত করা হয়। চিনা সমাজ নৈরাজ্যের মধ্যে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, চিনা রাষ্ট্র এবং তার সেনাবাহিনী বৃহত্তর কর্তৃত্ব অর্জন করে। ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখে। আর, মাওকে ঘিরে একটি ব্যক্তিত্বের অবয়ব তৈরি করে। এটা সর্বোচ্চস্তরে চলে গিয়েছিল, যখন চিনের জনগণ দেখেছিল হাতে বন্দুক নিয়ে রাষ্ট্রের শাসনকর্তার মূর্তি। আর, তার সঙ্গেই প্রচারিত হয়েছিল মাওয়ের লিটল রেড বুক। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব চিনা সমাজ, অর্থনীতি এবং আমলাতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রচার শুরু হওয়ার সময় থেকে ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলেছিল। যা পরবর্তী প্রায় তিন দশক চিনকে ভগ্ন সমাজ, রক্তপাত ও মৃত্যুপথযাত্রী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রেখেছিল।

১৯৮০-র দশকের সংস্কার
১৯৭৮ সালে চিন সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কার ঘোষণা করেছিল। যাকে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি, 'চিনা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্র' বলে দাবি করেছিল। চিন সরকার বাজারভিত্তিক সংস্কারের পক্ষে এই সময় মাওবাদ ত্যাগ করে স্থবির অর্থনীতিকে উত্সাহিত করেছিল। কৃষির সঙ্গে এই সময় চিন শিল্পে জোর দেওয়া শুরু করে। বিদেশি বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করে। শ্রমিকদের পরিযায়ী হওয়া থেকে ধর্মীয় নিপীড়ন, খাদ্যে রেশন থেকে হানাহানির চেয়ে ১৯৮০-র দশক ছিল অনেকটাই আলাদা। এই সময় জীবনযাত্রার মান দ্রুত উন্নত হচ্ছিল। কাজের সুযোগ বাড়ছিল। ফলে, জনগণ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে।

বেড়েছে অসন্তোষ ও প্রতিবাদ

কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার চিনের সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আনলেও, রাজনৈতিক সংস্কার তা অনুসরণ করেনি। অনেকেই আশা করেছিলেন যে অর্থনীতির পথ ধরেই 'রাজনৈতিক উন্মুক্তকরণ' ঘটবে। কিন্তু, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি এই ইস্যুতে অনেক বেশি বিভক্ত ছিল। কট্টরপন্থীরা কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। যেখানে দলের প্রগতিশীল শাখাগুলো বৃহত্তর গণতন্ত্রের আশা করেছিল। সিসিপি পরিচয়ের সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। একদিকে, এটি চিনকে একটি পূর্ণ বিকশিত বাজার অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্রের নীতিগুলি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা চালায়। তার ওপর, চিনের নবজাতক বাজার অর্থনীতি ছিল দুর্নীতিতে ভরা। এতে কিছু লোকই বেশি উপকৃত হয়েছিলেন। বেসরকারি কোম্পানিতে নিয়োগের সময় স্বজনপ্রীতি ছিল সাধারণ। মুদ্রাস্ফীতি ক্রমশ বাড়ছিল। চিন যখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছিল, তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাব অনুভূত হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সংস্কারের জেরে তৈরি পর প্রত্যাশা পূরণ না-হওয়ায় অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি, চিনের নানা জায়গায় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীরা বৃহত্তর বাক স্বাধীনতা, সেন্সরশিপ অপসারণ এবং চিনা রাজনীতির সামগ্রিক গণতন্ত্রীকরণের আহ্বান জানান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নিয়েও তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেন। এই বিক্ষোভগুলিতে ছাত্র এবং তরুণরাই ছিলেন নেতৃত্বে। কলেজ ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে ভিন্নমতের আড্ডাখানা। প্রথম প্রজন্মের ছাত্ররা, যাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন, চিনে ফিরে স্বাধীনতা, শাসন এবং সমাজ সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে এসেছিলেন। যা পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়ারের বিক্ষোভের রূপ নেয়। সেখানে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়।

Read full story in English

Maoist China Army agitation
Advertisment