আমাদের বয়ন শিল্প থেকে চিনকে মুছে ফেলা যাবে না

একটা বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে ৮০০ গ্রামের মত সিল্কের সুতো লাগে, ইক্কত শাড়ি তৈরি করতে লাগে এক কিলোগ্রাম।

একটা বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে ৮০০ গ্রামের মত সিল্কের সুতো লাগে, ইক্কত শাড়ি তৈরি করতে লাগে এক কিলোগ্রাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সরকারের বিকল্প পরিকাঠামো তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন হুসেন

চিনের পণ্য নিয়ে যখন চোখ কপালে উঠছে আর চিন নিপাত যাক ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত, সে সময়ে এ দেশের একটি শিল্প কাঁচা মালের জন্য চিনের পদতলে - ভারতের সিল্ক শিল্প।

Advertisment

বেনারসির তুখোড় বয়ন শিল্পী মকবুল হুসেনের কথায় "চিনা সিল্কের সুতো না এলে শুধু গোটা শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে তাই নয়, সিল্ক বোনার যে ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে, সে বেনারস হোক বা দেশের অন্য কোথাও, পুরোটা হারিয়ে যাবে।"

দেশের বয়ন শিল্পীরা যে সিল্কের সুতো ব্যবহার করেন তার ৮০ শতাংশ আসে চিন থেকে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ আসে কর্নাটক থেকে, বাকি ১০ শতাংশ বিহার ও আসাম থেকে। ভারতে মূলত সিল্কের সুতোর চারটি উৎস, যার মঘ্যে রয়েছে মালবেরি ও এড়ির মত ঘরে তৈরি, এনং তসর ও মুগার মত জংলি। হুসেনের কথায়, "ভিয়েতনাম ও কোরিয়াতেও বিকল্প সুতো তৈরি হয়, তবে তা আমাদের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।"

পৃথিবীর মঞ্চে বেনারসি শাড়ি শোপিস, সে লন্ডনের ১৮৫১ সালের গ্রেট একজিবিশন হোক, যেখানে জরি ও সিল্কের ব্যাপক ব্যবহার বয়নশিল্পীদের দক্ষতা ও কৌশলের সাক্ষ্যদান করেছে, বা ১৯৮০ র বিশ্বকর্মা প্রদর্শনী, যেখানে এসব শাড়ির সংগ্রহ প্রদর্শিত হয়েছে।

Advertisment

দস্তকারী হাত সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জয়া জেটলির কথায় "অনেক আগে বেনারসি শাড়ি তৈরি হত টিস্যু, সিল্ক ও রুপোর সুতে থেকে নেওয়া সূক্ষ্ম খাঁটি জরি থেকে, যার উপর থাকত সোনা। এই শাড়ি গলিয়ে ফেলা হলে বেশ ভাল পরিমাণ ধাতু পাওয়া যেত যা তখনকার দিনেও যথেষ্ট মূল্যবান। ফলে ব্যবসায়ীরা যে সে সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাড়ির বদলে বাসন নিয়ে আসতেন, তা অস্বাভাবিক নয়। বর্তমানের সুরাট জরি সে সময়ের যে খাঁটিত্ব তার সাথে তুলনীয় নয়।"

চিনের সিল্ক সুতোর উপর নির্ভরতার জেরে বেনারসি সিল্কে একটা আলাদা চাকচিক্য এসেছে, এবং খাঁটি জরির সেই ভারি ভাবও নেই। সেকেন্দ্রাবাদের বয়নশিল্পি গজম গোবর্ধন তাঁর অক্কতের কাজের জন্য পরিচিত। তিনি বললেন, সারা দেশে, সালেম থেকে ইরোদ থেকে পশ্চিমবঙ্গে, রাজস্থান ও বেনারস, সব জায়গার সিল্ক বয়ন নির্ভর করে থাকে চিনের সুতোর জন্য।

চিনের সুতো আর কর্নাটকের সুতোর মধ্যে তফাৎ ফিনিশিং ও ঘনত্বে। ভারতের মেশিনগুলিতে চিনের সুতোর মত মসৃণতা বা চাকচিক্য আসে না। মোটা সুতো হ্যান্ডলুমের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু পাওয়ারলুমে তা ব্যবহার করা যায় না।

"আমাদের রেশম চিনের চেয়ে ভাল এবং কর্নাটক থেকে যে সুতো আসে তার ঘনত্ব ও শক্তি চিনের সিল্কের সুতোর চেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল রিলিং আর ফিনিশিং।" বললেন হুসেন।

তবে অনেক দক্ষ হ্যান্ডলুম বয়নশিল্পী কর্নাটকে সিল্কের সুতো গিয়ে শাড়ি তৈরি করলেও, সমস্ত পাওয়ারলুমই চিনের সুতো ব্যবহার করে। বেনারসের বয়নশিল্পীদের অধিকাংশই পাওয়ারলুমে চলে যাওয়ার ফলে, স্থানীয় বাজারে যে চিনা সিল্ক সুতো বোঝাই কন্টেনার এসে পৌঁছচ্ছে, তাতে অস্বাভাবিকতা নেই।

গোবর্ধন বললেন "চিনের সিল্ক সুতোর দাম ও কর্নাটকের সিল্ক সুতোর দাম প্রায় এক, ৩৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা কিলো। তবে স্থানীয় সুতো ধোওয়ার পর ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।"

গায়ে যাতে রেশম গুটি না লেগে থাকে, সে কারণে সিল্কের সুতো সব সময়েই ধুয়ে নিতে হয়। কিন্তু চিনা সুতো ধুতে হয় না। একটা বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে ৮০০ গ্রামের মত সিল্কের সুতো লাগে, ইক্কত শাড়ি তৈরি করতে লাগে এক কিলোগ্রাম।

কর্নাটকের সিল্কের সুতোর উৎপাদন কমে যাওয়া থেকে রেশম চাষিরা প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়া, এ সবকেই দুষছেন গোবর্ধন।

"যেসব কৃষকরা বড় সংস্থার জন্য সব্জি বা ফল উৎপাদন করেন, তাঁরা সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পান, যার ফলে রেশম চাষিদের জন্য কিছুই থাকে না", বলললেন গোবর্ধন। জয়া জেটলি মনে করেন, চিনের সিল্কের সুতো যখন ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে তৈরি এড়ি, তসর ও খাদি সিল্ক তুলে ধরা যেতে পারে ও রেশমগুটি দেশের বয়নশিল্পীদের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সরকারের বিকল্প পরিকাঠামো তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন হুসেন। গোবর্ধন মনে করেন শুধু ভরতুকিতে কিছু হবে না। বয়নশিল্পীদের আত্মনির্ভরতার অনেক পথ রয়েছে। "যেসব বয়নশিল্পীরা দক্ষ তাঁদের চিহ্নিত করতে পারে সরকার। তাঁদের বাড়ি বানিয়ে গিয়ে তিন একর জমি দেওয়া যেতে পারে, যেখানে তাঁরা নিজেদের কাঁচামাল তৈরি করবেন, সে তুলো হোক কি সিল্ক। এমনকি চাষবাসও করতে পারেন। এর ফলে তাঁরা বিভিন্ন মরশুমে চাষবাসও করতে পারবেন, বুনতেও পারবেন।"