প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে বলেছেন যে, 'ভারতের মানুষ এই কঠিন সময়ে ইজরায়েলের পাশে আছে।' শনিবার হামাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, 'জঙ্গি হামলার খবর'-এ গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন। তবে, প্যালেস্তাইন নিয়ে এখনও পর্যন্ত ভারত কোনও বিবৃতি দেয়নি।
প্রশ্ন- কেন ভারত কূটনীতি প্রাথমিক বছরগুলোতে প্যালেস্টাইনের দিকে ঝুঁকেছিল?
উত্তর- ভারত ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব ১৮১ (২)-এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। এই প্রস্তাব ইহুদি এবং প্যালেস্তাইনের আরবদের মধ্যে প্যালেস্তাইনকে বিভাজিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পরিবর্তে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, যেখানে আরব এবং ইহুদিরা জেরুজালেমের জন্য বিশেষ মর্যাদা-সহ সর্বাধিক সম্ভাব্য স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবেন। নেহেরু এই দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরাধিকার সূত্রে মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ইহুদি জনগণের ঐতিহাসিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী গভীর সহানুভূতিশীল হলেও প্যালেস্তাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী অনুভব করেছিলেন যে ইজরায়েল তৈরি হলে ইতিমধ্যে সেখানে বসবাসকারী ৬০০,০০০ আরবের প্রতি অন্যায় হবে। সেই সূত্র ধরে নেহেরু প্যালেস্তাইন সমস্যার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেও দায়ী করেছিলেন।
ভারতের ইজরায়েল নীতি
বেশ কয়েকটি কারণে ভারতের ইজরায়েল নীতি রীতিমতো রঙিন। ভারত ১৯৫০ সালে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ভারতে একটি বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা আছে। দেশভাগের পরে, ভারতীয় নেতারা সেই মুসলিম জনসাধারণের মতামতের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল ছিলেন। আর, ভারতের মুসলমানরা সাধারণভাবে আরবদের প্রতিই সহানুভূতিশীল ছিল। এছাড়াও, ভারতীয় নেতারা আরব দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। পাকিস্তান দৃঢ়ভাবে প্যালেস্তাইনের পক্ষে ছিল। ফলে, ভারতকেও সেই অবস্থানের সঙ্গে মিল রাখতে হয়েছিল।
প্রশ্ন- ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন কি প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের সমর্থনকে পরিবর্তন করেছিল?
উত্তর- ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ভারতের অনীহাকে শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পশ্চিমী দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকানরা দৃঢ়ভাবে ইজরায়েলের পিছনে ছিল। আর, সেভাবেই সোভিয়েতরা আরবদের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছিল। ভারত, তার জোটনিরপেক্ষ অবস্থান সত্ত্বেও সোভিয়েতদের দিকে ঝুঁকেছিল। আর, সেই কারণেই ভারতের কাছে প্যালেস্তাইনের পক্ষ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
আরও পড়ুন- ১০০ বছরের রক্তপাত! গাজায় যুদ্ধ ইতিহাস, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের লড়াইয়ে নতুন করে প্রচারে
নরসিমহা রাওয়ের সময় থেকেই বদল
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরেই পিভি নরসিমা রাও সরকার অবশেষে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পতনের কথা চিন্তা না-করেই ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও অবশ্য প্যালেস্তাইনের প্রতি সোচ্চার সমর্থনও বজায় রেখেছিলেন। তিনি কোনওভাবেই প্যালেস্তাইনকে সমর্থন করা নিয়ে ভারতের নীতি বদলাননি। দিনের শেষে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইজরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি প্যালেস্তাইনের প্রতিও সমর্থন বজায় রাখা এবং আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রশ্ন- ভারত কি দেরিতে ইজরায়েলের হাত ধরল?
উত্তর- ভারত এখন আগের চেয়ে ইজরায়েলের অনেক বেশি কাছাকাছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধু। ভারত এবং ইজরায়েলও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে এই সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত ইজরায়েলের অন্যতম বড় খরিদ্দার। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের মধ্যে যা পরিবর্তন হয়েছে তা হল, প্যালেস্তাইনের সমর্থনে ভারতের প্রকাশ্য বক্তব্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত রাষ্ট্রসংঘের মত মঞ্চে ভারত এই বক্তব্যের সংখ্যা স্পষ্টতই কমিয়েছে।
প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী ইজরায়েলে গিয়েছেন
এমন একটি অনুভূতি তৈরি রয়েছে যে বছরের পর বছর ধরে ভারতের প্যালেস্তাইনপন্থী অবস্থান জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে লভ্যাংশ দেয়নি। সর্বোপরি, কাশ্মীর নিয়ে আরব দেশগুলো ভারতের জন্য কী দিয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, প্যালেস্তাইন প্রায়ই কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে ঘুরিয়ে সমর্থনের কথা বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অবস্থান পরিবর্তিত রয়েছে। বাস্তবে- ভারত ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন দুই রাষ্ট্রকেই সমর্থন করে। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনকে ভালো প্রতিবেশী হিসেবে দেখে। আর, সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ব্যাংকে রামাল্লা পরিদর্শন করেছিলেন। কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সেটাই প্রথম রামাল্লা সফর।
প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তানের তুলনায় প্যালেস্তাইন দুর্বল
ইজরায়েলের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক সমর্থনের একটি আদর্শগত উপাদানও থাকতে পারে। ভারতের অনেকেই গাজা উপত্যকা থেকে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ব্যাপারে ইজরায়েলের দৃঢ় প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন করেন। অনেকে আবার দাবি করেন, এটা ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ। এমনকী, আন্তঃসীমান্ত জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় অনেক ভারতীয়ই চান, ভারতও ইজরায়েলকে অনুসরণ করুক। অর্থাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের নীতি নিক। কিন্তু, ভারতের পরিস্থিতি একটু আলাদা। তা হল- ইজরায়েল একটি অত্যন্ত দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করছে। আর সেখানে পাকিস্তান এক শক্তিশালী সামরিক শক্তি। যাদের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের কি তার ইজরায়েলপন্থী অবস্থানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করা উচিত?
প্যালেস্তিনীয়রা খুশি হবে না। তারা কিছু সময়ের জন্য ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে খুশি নয়। তবে, বাকি আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। আরব দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী প্যালেস্তাইনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সৌদি আরবের মতো দেশ ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়। যদিও হামাসের আক্রমণ আরবদের কথোপকথনে প্যালেস্তাইন ইস্যুকে ফিরিয়ে আনবে। তবে, তাতে এই দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। নয়াদিল্লির ইজরায়েলপন্থী অবস্থানের কারণে কোনও আরব দেশ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করবে না বা হঠাৎ শত্রুতে পরিণত হবে না।
চিন্ময় ঘরেখানের পরিচিতি
চিন্ময় ঘরেখান ছিলেন রাষ্ট্রসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে রাষ্ট্রসংঘ মহাসচিবের দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়ায় ভারতের বিশেষ দূত ছিলেন। তাঁর সর্বশেষ বই, সেন্টারস অফ পাওয়ার: মাই ইয়ার্স ইন দ্য প্রাইম মিনিস্টার'স অফিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল, ২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত হয়েছিল।