কথায় আছে শুকনো কথায় কি চিড়ে ভেজে? সত্যি তাই কথায় তো চিড়ে কথায় ভেজে না। জল বা জলীয় কোন পানীয়, ফলের রস লাগবেই। জল বা দই দিয়ে চিড়ে খেতে হয়। গোটা ভারতবর্ষের সব রাজ্যেই খাদ্য তালিকায় সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সহজপাচ্য চিড়ে। চিড়ে পাওয়া যায় না এমন কিছু হাতে গোনা জায়গা আছে। শিশু, বাচ্চা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই খেতে পারে। সব ভাষাভাষী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চিড়ে সার্ব্বজনীন। মূলত নিরামিষ খাবার হিসাবেই খাওয়া হয়।
বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নাম। যেমন হিন্দিতে পোহা বা পাউয়া বা চূড়া, কন্নড় ভাষায় আভালাক্কী, গুজরাটিতে পাউয়া, রাজস্থানি ভাষায় পোয়া, চূড়া হল উড়িয়া ও মৈথিলীতে, তামিলে আভাল, নেপালি ও ভোজপুরিতে চিউরা, সিরা অসমিয়ায়। যে হেতু দেখতে চ্যাপ্টা, চাপ দিয়ে ধান চ্যাপ্টা করা হয় তাই একে ইংরেজীতে বিটেন রাইস বা ফ্লাটেন্ড রাইস বলা হয়। কিছু মানুষ চিড়ের বানান প্রায়ই ভুল করেন। চিড়ে ও মুড়ির "ড়" হয়ে যায় 'র'। মানে "চিরে, মুরি" আর কি। চিড়া ও চিড়ে সমার্থক।
সব ধানেরই চিড়ে হয়। ধান ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সামান্য ভেজে নিয়ে ঢেঁকিতে কুটতে হত। ইদানিং কালে মেশিনেই ভাঙানো হয়। ধানের খোসা পরে কুলোয় ঝেড়ে নিতে হয়। চিড়ে কিন্ত পুরোপুরি আতপ চালের বা পুরোপুরি সিদ্ধ চালের নয়।মাঝামাঝি বলা যেতে পারে। কোথাও পুজোর নৈবেদ্যর জন্য চিড়ে দেওয়ার চল আছে। আগে ঢেঁকিতেই ধান ভাঙানো, চাল গুড়ো করা, চিড়ে তৈরি করা হত। এখন দ্রত ও বেশি পরিমাণে তৈরির জন্য মেশিনে হচ্ছে। চালের থেকে হালকা, সহজে বহনযোগ্য। এমনকি চালের থেকে বেশি দিন ঘরে রাখা য়ায়।
এখন বাজারে মোটামুটি ভাবে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। চালের রকমফের অনুযায়ী মোটা , মাঝারি ও সরু বা পাতলা চিড়ে হয়। আধুনিক জাত লালস্বর্ণ চালের চিড়ে মোটা, ভিজতে সময় বেশি লাগে। আবার দেশি চাল কালো মোটা, দোরাঙি, মৌল ধানের চিড়ে মোটা ও ভারী হয়। পাটনাই ২৩, সবিতা, ঝিঙেশালের চিড়ে মাঝারি হয়। লালসরু ও দুধের সর চালের চিড়ে সরু ও ছোট। কারুর মোটা পছন্দ বা কারুর সরু। মাঠের কাজে পান্তা ভাতের জুড়ি মেলা ভার। কিন্ত যেখানে পান্তা ভাত বা ভাত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না সেখানে চিড়েই ভরসা। চিড়ে ধোয়া জল পেটের অসুখে কার্যকরী। অফিসের টিফিন খুব সহজেই হয় চিড়ে দিয়ে। কলকাতার অফিস পাড়ায় তো দই চিড়ে বিক্রিও হয়।
এখন বাজারে রেডি টু ইট খাবারের ছড়াছড়ি। চাউমিন, পিৎসা, নুডুলস ইত্যাদি। আমরা তো এখন অনেক বিদেশি খাবার এখন আমরা খাচ্ছি তার মধ্যে প্যাকেটজাত খাবারে নানারকম রাসায়নিক রয়েছে।এটি রেডি টু ইট খাবার, সুস্বাদু, সহজপাচ্য, ঝামেলা বিহীন, জ্বালানী সাশ্রয়কারী, সহজ লভ্য এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার। সকালে দই, চিড়ে ও কলা অনেকেই পছন্দ করেন। আমের মরশুমে চিড়ের সঙ্গে পাকা আমের স্বাদই আলাদা। বলা বাহুল্য আপনি গুড় ও টক দই সহযোগেও চিড়ে খেতে পারেন। চিনি ও দুধ দিয়ে খেতে পারেন। ভাত রান্না করার কোন ঝামেলা নেই অথচ সহজেই ভাত রুটি ছাড়া কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা পূরণ হল।
দই-চিড়ে বাংলা, আসাম ও ওড়িষ্যার একটি চালু খাবার। দক্ষিণ ভারতে এর সঙ্গে নারকোল কোরা মেশানো হয়। চিড়ের মাধ্যমে ভাতের পুষ্টিগুণ আপনি খুব সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন। চিড়ের চালের উপরের পুষ্টিকর তুষ থেকে যায়, ফলে চালের থেকে অনেক বেশি পুষ্টিকর। প্রোটিন, খনিজ, বি ভিটামিন ও বেশী ফাইবার সমৃদ্ধ। কারণ এখনকার চকচকে পালিশ করা সাদা চালে প্রায় ৬০% পুষ্টিগুণ কম। চিড়ে থেকে নানা রকম খাবার তৈরি করা যায়।
মধ্য ও উত্তর ভারতে খুব জনপ্রিয় একটা প্রাতরাশ হল পোহা। শুধু বাড়ি নয় দোকান থেকেও বিক্রি হয় ৮-১০ টাকা প্লেট। পোহারও রকম ফের আছে। প্রথমে পাত্রে তেজপাতা, কাঁচালঙ্কা, পাঁচফোড়ন বা মৌরি তেলে ভেজে নেওয়া হল পরে সরু করে কাটা আলু, লবন, হলুদ,মটরশুটি/সামান্য বাদাম দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে।এরপর মোটা চিড়ে ধুয়ে নিয়ে ওই পাত্রে দিয়ে নেড়ে চেড়ে নেওয়ার পর কিসমিস ও ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে। তৈরি হয়ে গেল পোহা বা চিড়ের পোলাও। প্রয়োজন মত পিঁয়াজ দেওয়া যেতে পারে। শ্রীলঙ্কাতে ভেজানো চিড়ে সামান্য চাপ দিয়ে পনিরের মত করা হয়। বরফির মত টুকরো করে পিঁয়াজের তরকারি সহযোগে খাওয়া হয়। এটাও কিন্তু শ্রীলঙ্কার প্রচলিত প্রাতঃরাশ। ওদেশে হাবলা পেথি কান্দা হল চিড়ের তৈরি সুপ। চিড়ে ভাজা রেডিমেড প্যাকেটে বাংলার সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। গুড় দিয়ে তৈরি চিড়ের মোয়া এখন প্যাকেটে পাওয়া যায়। ভাজা চিড়ে টক দই ও চিনি দিয়েও খাওয়া হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে চিড়ে ও গুড়ের তৈরি নরম আতুকুলা লাড্ডু পাওয়া যায়। গোটা ভারত জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চিড়ের তৈরি আভাল পায়েশম (চিড়ের পায়েশ), পোহা ধোকলার মত নানা পদ।
সুগন্ধী চিড়ের জন্য আপনাকে গোবিন্দভোগ, রাধাতিলক, কালাভাত, আাদানছিলপা, কালোনুনিয়া তুলাইপাঞ্জি ইত্যাদি দেশজ ধানের চিড়ে খেতে হবে, অবশ্যই দামটা অনেক বেশি পড়বে- ১০০ টাকা বা তার বেশি। কালাভাত হল পৃথিবীর সবথেকে পুষ্টিকর চাল, চালের রং লালচে কালো, সুগন্ধী, প্রচুর ফাইবার ও ক্যানসার প্রতিরোধক অ্যান্টি অক্সিডেন্টযুক্ত। ডায়াবেটিসের জন্য সাদা ভাত খেতে অসুবিধা থাকলে কালাভাতের চিড়ে অবশ্য একটি আদর্শ বিকল্প। কালোচালের ভাত বা চিড়ে খেয়ে রক্তে শর্করা অনেক ধীরে বাড়ে। লালচে সুগন্ধি চিড়ে হয় আদান ছিলপা ও হাতি ধান থেকে। লালচে অসুগন্ধী চিড়ে হয় ষাটিয়া, খাড়া, লাল দুধেরসর, অগ্নিবাণের থেকে। সে সবের স্বাদই আলাদা। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় কৃষকরা নিজেদের মত করে চিড়ে উৎপাদন ও বিপণন করছেন।
(ডক্টর অনুপম পাল নদিয়ার ফুলিয়ায় রাজ্য সরকারের কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর)