গত সপ্তাহে আইআইটি কানপুরের এক অধ্যাপক অভিযোগ করেছেন জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে পুলিশি ধরপাকড়ের প্রতিবাদের সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। প্রয়াত পাকিস্তানি কবি ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজের কবিতার দুটি লাইন ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদের সময় নিজেদের গলায় তুলে এনেছিলেন। বিক্ষোভকারীদের কবিতার পংক্তি ব্যবহারেই আপত্তি জানিয়েছেন ওই অধ্যাপক।
কবি ও কবিতা
ফৈয়াজের কবিতা ওয়া ইয়াবকা ওয়াঝ ও রাব্বিক- কোরাণ থেকে নেওয়া। এর আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের সামনে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থের চেয়ে যে অর্থ অনেক বেশি চালু তা হল হাম দেখেঙ্গে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এ কবিতাকে ঘিরে যে মিথোলজি এবং এবং পাকিস্তানি গজল গায়র ইকবাল বানো এ কবিতার যে সাঙ্গীতিক রূপান্তর ঘটিয়েছেন, তা প্রতিটি নয়া বিক্ষোভে বারবার উঠে এসেছে, মনে করিয়ে দিয়েছে বৈপ্লবিক ওই কাব্যকে। এর একটি অডিও রেকর্ডিং ইউটিউবেও পাওয়া যাচ্ছে।
ফৈয়াজ ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। বিপ্লবের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক কাঠামোকে আক্রমণ করার জন্য তিনি ব্যবহার করতেন ধর্মীয় ঐতিহ্যের ইমেজারি। হাম দেখেঙ্গে-তে কয়ামতের বর্ণনা রয়েছে, যা এ কবিতায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিনে রূপান্তরিত হতেন।
এ কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। পাকিস্তানে তখন সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়া উল হকের শাসনকাল। ১৯৭৭ সালে জিয়া উল হক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসনচ্যুত করেন এবং ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজেকে পাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। জিয়ার একনায়কত্ব খুব শীঘ্রই কঠোর ধর্মীয় দিকে বাঁক নেয়, এবং তিনি গোঁড়া ইসলাম ধর্মকে দমনপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দেশের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেন। হাম দেখেঙ্গে কবিতায় ফৈয়জ, জিয়া উল হককে ক্ষমতার উপাসক হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর কবিতায় জিয়া আল্লাহে বিশ্বাসী নন। বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এভাবেই বিপ্লবকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।
হাম দেখেঙ্গেকে সেন্সর করা হয়েছিল। ফৈয়াজ সমগ্রতেও তা পাওয়া যায় না। কোক স্টুডিও গত বছর এ গানের যে ভার্সন প্রকাশ করেছে তা থেকেও একটি অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। সে অংশটি এই কবিতার সবচেয়ে বৈপ্লবিক অংশ বলে অনেকেই মনে করেন।
জব আর্জ-এ-খুদা কা কাবে সে, সব বুট উঠায়ে যায়েঙ্গে / হাম আহলে-এ-সফা মরদুদ-এ-হারাম, মসনদ পে বিঠায়ে যায়েঙ্গে / সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে, সব তখত গির যায়েঙ্গে
ঈশ্বরের আঙিনা থেকে যখন মিথ্যার বেসাতিদের সরিয়ে দেওয়া হবে / আমরা, বিশ্বাসীরা, যারা পবিত্রভূমিতে নিষিদ্ধ, তাদের বসানো হবে উঁচু বেদীতে / মুকুট খসে পড়বে, উৎপাটিত হবে তখত
গায়িকা ও পরিপ্রেক্ষিত
হাম দেখেঙ্গে এক দিক থেকে যেমন জনপ্রিয়, তেমনই শক্তিশালী। একইসঙ্গে এ কবিতা ১৯৮৬ সালে ইকবাল বানোর কণ্ঠসংগীতের মাধ্যমে বিদ্রোহ আর বিক্ষোভের সংগীত হয়ে ওঠে। ইকবাল বানোর গানের রেকর্ডিং পাকিস্তানের বাইরে গোপনে পাচার হয়ে যায়। ইকবাল বানো এক অর্থে ফৈয়াজকে অমরত্ব দেন।
ইকবাল বানো এ গান গেয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, লাহোরের আলহামারা আর্টস কাউন্সিলে। সে দিনের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বয়ান পাওয়া যায় ফৈয়াজের পৌত্র আলি মাদিহ হাশমির কাছে।
ফৈয়াজ মারা যান ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে। ফৈয়াজ ফাউন্ডেশন তাঁর জন্মদিনে ফৈয়াজ মেলা অনুষ্ঠিত করে। খোলা মাঠের এই মেলায় সন্ধেবেলা গানের অনুষ্ঠান হয়।
১৯৮৬ সালের গানের অনুষ্ঠানের শিল্পী ছিলেন ইকবাল বানো। হাশমি সে দিনের ঘটনার কথা মনে করতে পারেন। ইকবাল বানো মঞ্চে আসার আগেই ৪০০ থেকে ৬০০ মানুষের এই হল ছিল ভরা। (হাশমি বলেছেন, ৫০ হাজার মানুষ সেদিন উপস্থিত ছিলেন বলে যে কথা চালু আছে তা অবাস্তব।) সমস্ত আসন পূরণ হবার পর হলের দরজা খুলে দেওয়া হয়, যাতে বাইরের লোকেরা হলে ঢুকতে পারেন। হল ভরে যায় কানায় কানায়।
ইকবাল বানো সেদিন গেয়েছিলেন ফৈয়াজের অনেকগুলি কবিতা। সবচেয়ে বেশি করতালি এসেছিল হাম দেখেঙ্গের পর। তিনি কনসার্ট শেষ করবার পরেও জনতা তাঁকে বেরোতে দিতে চায়নি, ফের একবার হাম দেখেঙ্গে শুনতে চেয়েছিল তারা। ইকবাল বানো জনতার অনুরোধ মেনে নেন। আলহামারার এক টেকনিশিয়ান সে গান রেকর্ড করেন- সেই রেকর্ডিংটাই আজও টিকে আছে।
হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়েছিল হল। হাশমির কথায় এক এক সময়ে মনে হচ্ছিল হলের ছাদ বুঝি ভেঙে পড়বে। ইকবাল বানোকে বার বার গান থামিয়ে দিতে হচ্ছিল হর্ষধ্বনি আর ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের জন্য। "সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে যায়েঙ্গে" যখন গাওয়া হচ্ছিল তখন হর্ষধ্বনি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি তুমুল।
কনসার্ট শেষ হবার পর
কবি গওহর রাজা তাঁর এক পাকিস্তানি বন্ধুর সম্পর্কে লিখেছেন। সে বন্ধু সেদিনের কনসার্টে হাজির ছিলেন। তিনি সেদিন রাতে পাক সামরিক বাহিনীর এক বিশেষ পরিচিতের কাছ থেকে একটি ফোন পান। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি গওহরের বন্ধুকে উপদেশ দিয়েছিলেন পরের দুতিন দিন বাড়িতে না থাকতে। সে উপদেশ মেনে নিয়েছিলেন গওহরের বন্ধু। পরপর কয়েকদিন ধরে সেদিন লাহোরের ওই অনুষ্ঠানে যাঁরা হাজির ছিলেন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কাউকে কাউকে আটকও করা হয়। গওহরের বন্ধুর বাড়িতে সেদিন গভীর রাতে মিলিটারি পুলিশ এসেছিল।
ইকবাল বানোর গানের বহু কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। হাশমির এক আত্মীয় একটি কপি কোনওক্রমে রক্ষা করেন, এবং বন্ধুদের হাত দিয়ে চোরাপথে দুবাই পাঠান। সেখান থেকেই ইকবাল গানোর গানের কপি ছড়িয় পড়ে।
১৯৬৭ সালে আটলান্টায় উই শ্যাল ওভারকাম গাইবার আগে মার্কিন গায়ক পিট সিগার বলেছিলেন- "গান খুব গোপন জিনিস, বন্ধুরা। গান সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে। কারাগারে ঢুকে পড়তে পারে। কঠিন বর্ম অতিক্রম করতে পারে। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত গান ইতিহাস বদলে দিতে পারে।"
ইকবাল বানো ফৈয়াজের হাম দেখেঙ্গে ১৯৮৬ সালে গেয়েছিলেন। দু বছর পর, ১৯৮৮ সালের অগাস্ট মাসে জিয়া মারা যান। তাঁর ১১ বছরের শাসনকাল শেষ হয় এক বিমান দুর্ঘটনায়।