১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নেতা মাও দে জং আধুনিক চিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সিসিপি আজও চিনের সরকার এবং সামরিক বাহিনী গঠনকারী কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল যে কমিউনিজমের মতাদর্শ চিনে কীভাবে এল এবং কেন তা চিনেই প্রাধান্য পেল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে বলতে হয়, চিন আসলে সেই সময় এক দর্শনের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। সেই দর্শন ছিল তার কমিউনিজমের রাস্তা। বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি খেলোয়াড় এবং একজন ভারতীয় নেতা এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কেন কমিউনিজম?
বিংশ শতাব্দীতে অনেক দেশই ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছিল এবং তাদের নিজেদের জন্য একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পথ বেছে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) আশপাশে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট ইউএসএসআর-এর বাইরের ক্ষমতা সেই সময় গোটা বিশ্ব দেখতে পাচ্ছিল। ওই দুই রাষ্ট্রও তাদের আদর্শ এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য সেই সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছিল। যাকে বলা হয়, 'শীতল যুদ্ধ'। এই যুদ্ধে ওই দুই দেশ নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে না-জড়ালেও তারা অন্যান্য দেশ এবং জাতিকে প্রভাবিত করা শুরু করেছিল। কিন্তু, চিনের কমিউনিজমের পথ অনুসরণ ১৯০০ দশকের গোড়ার দিকে এক অস্থির সময়ের পরেই শুরু হয়েছিল।
অভ্যন্তরীণ সমস্যা
২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিন ছিল স্থানীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত। সেখানে একাধিক যুদ্ধরত রাজ্য ছিল। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা শুরু হয়। প্রথম সফলতা অর্জন করেছিলেন কিন রাজবংশের রাজা শি হুয়াং। কিন রাজবংশ শুরু হয়েছিল ১৭ শতকের মাঝামাঝি। ১৯ শতকের মধ্যে, দুর্নীতি এবং অপশাসনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কারণে এই রাজবংশের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে।
বিদেশিদের উপস্থিতি
সেই সময়ে চিনে উত্পাদিত প্রচুর পরিমাণে চা ব্রিটেন কিনেছিল। কিন্তু, সেই চা ব্রিটেনের সম্পদকে শূন্য করে দিচ্ছিল। এটি বন্ধ করার জন্য, ব্রিটেন চিনাদের কাছে আফিম বিক্রি শুরু করে। যাতে চিনারা ব্রিটেন থেকে পণ্য কেনার জন্য তাদের সম্পদ ব্যয় করতে বাধ্য হয়। এই আফিম সরবরাহ বন্ধ করার জন্য চিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, ১৮৩৯ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে চিন হেরে যায় এবং হংকংয়ের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ অংশ ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতে হয়। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের বৃহত্তর বাণিজ্য ছাড় দিতে বাধ্য হয়। বিদেশি শক্তিগুলো সেই সময় চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বাড়ানো শুরু করে।
বক্সার বিদ্রোহ
এই 'অসম' চুক্তির বিরুদ্ধে চিনের কিছু কৃষক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। তাঁদেরকে বিদেশিরা 'বক্সার' নামে চিহ্নিত করত। কারণ ওই কৃষকরা এক ধরনের মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তারা বিদেশি উপস্থিতি, সরকারি দুর্নীতি এবং ঐতিহ্যবাহী চিনা সমাজে খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। চিনের সম্রাজ্ঞী তাঁদের সমর্থন করেছিল। কিন্তু, আটটি মিত্র দেশ (অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)-এর সৈন্যরা ১৯০০ সালের বক্সার বিদ্রোহকে চূর্ণ করে। ফলে, চিনের ওপর বিদেশিরা আরও বেশি শর্ত আরোপ করেছিল।
আরও পড়ুন- ভারতের মুদ্রায় গান্ধীজি! ছবিটা কবে, কখন তোলা হয়েছিল?
প্রেসিডেন্ট ঘোষণা
এই পরিস্থিতিতে চিনে রাজার বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে শুরু করে। ১৯১১ সালে একটি প্রদেশে সৈন্যদের বিদ্রোহের মাধ্যমে সিনহাই বিপ্লব শুরু হয়। এটি আরও ছড়িয়ে পড়ে এবং অবশেষে বালক সম্রাট জুয়ানটং-এর অপসারণ ঘটায়। বিপ্লবীরা ১৯১২ সালে ডাক্তার থেকে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠা সুন ইয়াত সেনকে চিনের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে।