ইজরায়েল তার ইতিহাসে গাজা ভূখণ্ডে সবচেয়ে খারাপ হামলার শিকার হয়েছে গত ৭ অক্টোবর। এরপর প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজা উপত্যকার দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিক সংগঠন থেকে জঙ্গি সংগঠনে বদলে যাওয়া হামাসকে 'চূর্ণ-বিচূর্ণ এবং ধ্বংস' করার প্রতিশ্রুতি দেন। যাইহোক, বিভিন্ন মহলের দাবি, ইজরায়েল সরকারই এতদিন ধরে হামাসকে শক্তিশালী করে তুলেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক দল ফাতাহকে দুর্বল করা। যার জের গাজা এবং পশ্চিম তীরের প্যালেস্তিনীয় অঞ্চলগুলি হামাস আর ফাতাহর মধ্যে বিভক্ত হয়েছিল। কিন্তু, অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, ইজরায়েল কেন ফাতাহকে দুর্বল করে হামাসকে শক্তিশালী করতে চাইবে, এতে তাদের কী স্বার্থ?
ফাতাহর সৃষ্টি
ফাতাহ হল হরকাত আল-তাহরির আল-ওয়াতানি ই-ফিলিস্তিনি এর বিপরীত সংক্ষিপ্ত রূপ। যার অর্থ হল, 'প্যালেস্তাইনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন'। এই সংগঠন ১৯৫৯ সালে ইয়াসির আরাফাত (১৯২৯-২০০৪)-সহ প্যালেস্তাইনের প্রবাসী সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে, এই সংগঠন হিংসার রাস্তা ত্যাগ করে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৩-৯৫ সালের অসলো চুক্তি, যেখানে ইজরাইল এবং প্যালেস্তাইন প্রথমবারের মতো একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়- আরাফাতের অধীনেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই সময় ধর্মনিরপেক্ষ এবং মধ্যপন্থী ফাতাহকে পশ্চিমের রাজধানীগুলিও স্বীকৃতি দিয়েছিল। সাহায্য করার অংশ হিসেবে প্যালেস্তাইন তথা ফাতাহকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল। তারপরও প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের চাপ অব্যাহত ছিল।
হামাসের সৃষ্টি
অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে আলোচনা এবং চুক্তিগুলি তাদের সাহায্য করেনি। হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া (ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন) বা হামাস, মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা। এটি ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে বিশ্বাসী। যদিও প্রাথমিকভাবে, হামাসকে ইজরায়েল স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু, ২০১৭ সালে ইজরায়েল জানিয়ে দেয় যে তারা ১৯৬৭ সালের সীমানার ওপর ভিত্তি করে একটি প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র মেনে নিতে ইচ্ছুক। তার মধ্যেই হামাসের শক্তিশালী ইসলামি আদর্শ ও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তার আপোষহীন প্রতিরোধ হামাসকে প্যালেস্তিনীয়দের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মিশর এবং জাপান হামাসকে একটি আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে।
ইজরায়েলের সেনা প্রত্যাহার
পরে ২০০৫ সালে ইজরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার আগে, ২০ লক্ষেরও বেশি প্যালেস্তিনীয়র বাড়ি ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ইজরায়েল দখল করে রেখেছিল। ২০০৫ সালে আবার হামাস প্যালেস্তাইনের জনজীবনে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে প্যালেস্তাইনে আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে গাজায় ফাতাহকে পরাজিত করে হামাস। দুই পক্ষ ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তিতে আসতে পারেনি। আর, তার মধ্যেই হামাস গাজার দখল নেয়।
গাজা অবরোধ
এই পরিস্থিতিতে ইজরায়েল এবং পশ্চিমী দেশগুলো গাজায় হামাসের সরকারকে তিনটি শর্তে রাজি না-হওয়া পর্যন্ত স্বীকার করতে রাজি নয় বলে জানিয়ে দেয়। যে তিনটি শর্ত ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হল- হিংসা ত্যাগ করা, ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পূর্ববর্তী সমস্ত চুক্তি মেনে চলা। সেই সব না-করায় ইজরায়েল এবং পশ্চিমী দেশগুলো হামাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাশাপাশি, ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাসকে চাপ দিতে থাকে যাতে তারা হামাসের সরকারকে বরখাস্ত করে। এরপর ২০০৭ সালে, ফাতাহ এবং হামাস মক্কা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যার লক্ষ্য ছিল সংঘর্ষের অবসান এবং একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা। যার ভিত্তিতে ফাতাহ এবং হামাস যৌথ সরকার গঠন করে। কিন্তু, তাদের চুক্তিটি কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশ্যে চলে আসে। তারপরই হামাস গাজা দখল করে নেয়। আর, সেই থেকে গাজায় ক্ষমতায় রয়েছে। পালটা ইজরায়েল গাজা সম্পূর্ণ অবরোধ করে।
হামাসকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ইজরায়েল?
আর, এখানেই প্রশ্ন যে ইজরায়েল কেন হামাসকে শক্তিশালী করতে চাইবে, বিশেষ করে যার মূল আদর্শই হল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানো? কারণ, হিসেবে বিভিন্ন প্যালেস্তিনীয় বিশেষজ্ঞ বলছেন যে কেবলমাত্র একটি বিভক্ত প্যালেস্তিনীয় নেতৃত্বের অর্থ হল যে, প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা কখনও এগোবে না। এই বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, ফাতাহকে মূলত শান্তির জন্য আলোচনাকারী একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে দেখা হয়। সেই জন্য, শুধু ফাতাহ থাকলে ইজরায়েলকেও প্যালেস্তাইন সৃষ্টির জন্য একটি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অথবা, শান্তি আলোচনার পক্ষ হতে হবে। কিন্তু, নেতৃত্ব বিভক্ত হলে তার দায় ইজরায়েলের নয়। টাইমস অফ ইজরায়েল অনুসারে, নেতানিয়াহু ২০১৯ সালে একটি দলীয় সভায় বলেছিলেন যে, 'যারা প্যালেস্তিনীয় রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে তাদের গাজায় তহবিল স্থানান্তরকে সমর্থন করা উচিত। কারণ, তাতেই পশ্চিম তীরের প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। আর, গাজায় হামাস প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা দেবে।'