পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে দুই অঙ্কের আসন পেয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশক দেশ চালিয়ে আসা কংগ্রেস। এবার তারা অস্তিত্বের সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। কংগ্রেসের পুরনো নির্বাচনী অঙ্ক এবং আভ্যন্তরীণ সংকটের এক ঝলক-
নেহরু বনাম দক্ষিণ পন্থী
দেশের স্বাধীনতা ও মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পরপরই কংগ্রেসের বড় সংকট তৈরি এসেছিল দলের অভ্যন্তরস্থ দক্ষিণপন্থী শক্তির কাছ থেকে। নিজের দর্শন, বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা দলের মধ্যে টিকিয়ে রাখতে জওহরলাল নেহরুকে লড়তে হয়েছিল পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, কে এম মুন্সি এবং নারহার বিষ্ণু গ্যাডগিলের মত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। অবস্থা এতই ঘোরালো হয়ে উঠেছিল যে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্যান্ডন ঘোষণা করেছিলেন তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। স্বাধীন ভারতে এই পদের জন্য সেই ছিল প্রথম প্রকাশ্য নির্বাচন।
অন্য় প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন জেবি কৃপালনি এবং শঙ্কররাও দেও। দক্ষিণপন্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যদিও সে ক্ষমতা তিনি সর্বদা ব্যবহার করেননি। ট্যান্ডন কৃপালনির চেয়ে ১০০০ বেশি ভোট পান। এ ঘটনায় নেহরু এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন যে তিনি ট্য়ান্ডনের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হতে অস্বীকার করেন। ডিসেম্বর মাসে প্যাটেলের মৃত্যুর পর ফের একবার সামনে আসে মতদ্বৈধতা। সে সময়ে ওয়ার্কিং কমিটিতে রফি আহমেদ কিদওয়াইকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে নেহরুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কিদওয়াই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং কৃপালনির সঙ্গে হাত মেলান। কৃপালনি তার আগেই কিষাণ মজদুর পার্টি গঠন করে ফেলেছেন।
১৯৫১ সালের জুলাই মাসে যখন নেহরু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন তখন ফের সংকট ঘনীভূত হয়। সাধারণ নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতে ট্যান্ডন শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করেন এবং অক্টোবর মাসে দিল্লিতে এআইসিসি-র অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচিত হন নেহরু।
ইন্দিরা গান্ধী বনাম সিন্ডিকেট
পরের দশকের শেষদিকে আরও বড় সংকটের মুখে পড়ে কংগ্রেস। এবার সংকট ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ক। মোহন কুমারমঙ্গলম এবং পি এন হাসকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্যাঙ্ক ও ভারী শিল্প জাতীয়করণের দিকে ঝোঁকেন। উল্টোদিকে মোরারজি দেশাই ছিলেন মিশ্র অর্থনৈতিক মডেলের পক্ষে, যে মডেল নেহরুর সময়ে পার্টির অভ্যন্তরে সমাজবাদী ও পুঁজিবাদী ধারার মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে এআইসিসির অধিবেশনে নোট অন ইকোনমিক পলিসি অ্যান্ড প্রোগ্রাম প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ওই নোটে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের রূপরেখা আলোচনা করা হয়েছিল।
এর তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছিল মোরারজি দেশাইয়ের কাছ থেকে, যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ইন্দিরা বনাম সিন্ডিকেটের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গিয়ে দাঁড়ায়। ইন্দিরার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে কংগ্রেস সভাপতি পদে নীলম সঞ্জীব রেড্ডির নাম ঘোষণা করা হয়। তিনি সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভিভি গিরির প্রতি সমর্থন জানান। এর ফলে কংগ্রেস সভাপতি এস নিজলিঙ্গাপ্পা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ইন্দিরা তাঁকে পদ থেকে সরাতে চান।
সে বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সমান্তরাল ভাবে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, একটি কংগ্রেস সদর দফতের, অন্যটি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। কয়েকদিন পর নিজলিঙ্গাপ্পা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেন। পার্টি ভেঙে য়ায়। ইন্দিরা বাধ্য হয়ে গাই-বাছুরের নতুন প্রতীক নেন। ডিসেম্বর মাসে দু পক্ষই আলাদা আলাদা ভেবে এআইসিসির অধিবেশন আয়োজন করে। ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর বম্বে সেশনে ইন্দিরা কংগ্রেস জগজীবন রামকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (ও) ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে কিন্তু সে প্রস্তাব পরাজিত হয়। ১৯৭১ সালে নির্বাচন আহ্বান করেন ইন্দিরা এবং দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
জরুরি অবস্থা ও তার পর
১৯৭৫ সালের জুন মাসে ইন্দিরা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্য়াহৃত হওয়ার পর ভোটে হেরে যায় কংগ্রেস। ইন্দিরা নিজে হারেন রায়বেরিলি থেকে। ফের পার্টি ভাঙে জগজীবন রামের নেতৃত্বে। কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধী তখন কার্যত রাজনীতির মাঠহারা এবং প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে তখন সুদৃঢ় দেখাচ্ছে। ইন্দিরা সহ বেশ কিছু কংগ্রেস নেতাকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু স্রোত ঘুরছিল কংগ্রেসের দিকেই।
শাসক দল জনতা পার্টির সভাপতি চন্দ্র শেখর প্রাক্তন জনসংঘ সদস্যদের দ্বৈত সদস্যপদ নিয়ে প্রশন তোলেন। সরকারে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের বলা হয় সরকার বা আরএসএস - যে কোনও একটি পক্ষ বেছে নিতে। অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং এল কে আদবানি সর
ঐতিহাসিক জনাদেশ, এবং ছত্রভঙ্গ
১৯৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা কংগ্রেসের পক্ষে বিশাল সহানুভূতির ঢেউ হয়ে দেখা দেয় এবং তাঁর পুত্র রাজীব ৪০০র বেশি আসন নিয়ে মসনদে বসেন। কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুত্ব নিয়ে তাঁর চাল - উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিংকে বাধ্য করা এবং ১৯৮৬ সালে সেখানে ধর্মাচরণের সুযোগ করে দেওয়া দলের মধ্যে অসন্তোষ সূচনা করে এবং বোফর্স কেলেঙ্কারি পতনের কারণ হয়। অর্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস ছাড়েন এবং বহু মোহমুক্ত কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জন মোর্চা তৈরি করেন।
১৯৮৯ সালের ভোটে ১৯৭টি আসন পেয়ে কংগ্রেস পরাস্ত হয়। ১৯৯১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেস সভাপতি পদে আসীন হন এবং পদে থাকাকালীনই তাঁকে হত্যা করা হয়। এর পর দলে ফের ঝড় শুরু হয় তবে ১৯৯১ সালে আরও একবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হন পিভি নরসীমা রাও।
১৯৯০-২০০০: সমস্যার দশক
১৯৯০-এ কংগ্রেস বেশ কিছু ভাঙনের মুখে পড়ে। ক্ষমতায় বসার পরেই সরকার চালাতে সমস্যায় পড়েন নরসীমা রাও, সমস্যা হয় দলেও। তাঁর সঙ্গে অর্জুন সিং এবং এনডি তিওয়ারির মত বর্ষীয়ান নেতাদের বিশ্বাসের সমস্যা তৈরি হয়। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে এআইসিসি-র তিরুপতি অধিবেশনে অর্জুন সিং সবচেয়ে বেশি ভোটে জেতেন অর্জুন সিং, জেতেন শরদ পাওয়ারও। মহিলা এবং দলিতদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব নেই এই ইস্যু তুলে নরসীমা রাও ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত নবনির্বাচিত সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলেন। এরপর তিনি নতুন করে ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করেন এবং অর্জুন সিংকে সেখানে মনোনীত সদস্য হিসেবে স্থান দেন।
এতেও সমস্যা শেষ হয়নি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে অর্জুন সিং বলা শুরু করেন যে নরসীমা রাও যথেষ্ট পরিমাণ ধর্মনিরপেক্ষ নন। এরপর যে ক্ষমতার যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে সোনিয়া গান্ধীর সমর্থন হারান রাও। তার কারণ ছিল রাজীব হত্যা নিয়ে ততটা মুখর ছিলেন না তিনি। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা সোনিয়াকে জানিয়েছিলেন যে ভারত সরকার এই হত্যাকাণ্ডে যুক্তদের প্রত্যর্পণের আবেদনই করেনি।
১৯৯৪ সালে কংগ্রেস রাওয়ের নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে পরাজিত হয় এবং তার ফলে তাঁর সমালোচকরা আরও মুখর হয়ে ওঠেন। এর জেরে অর্জুন সিংকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং পার্টি থেকে সাসপেন্ডও করা হয়। যার ফলে দল ভাঙনের মুখে পড়ে। এন ডি তেওয়ারিকে সভাপতি এবং অর্জুন সিংকে কার্যকরী সম্পাদক করে আরেকটি গোষ্ঠী তৈরি হয়। পাঁচ বছর সংখ্যালঘু সরকার চালানোর পর ১৯৯৬ সালে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়।
এরপর কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে আট বছর পর। নরসীমা রাও পদত্যাগ করেন এবং তাঁর জায়গা নেন সীতারাম কেশরী, কিন্তু তিনিও বর্ষীয়ান নেতাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ১৯৯৭ সালে কংগ্রেসের প্রসিডেন্ট হিসেেব পাওয়ার ও রাজেশ পাইলটকে হারিয়ে দেন সীতারাম কেশরী। দু বছর পর সোনিয়া ক্ষমতায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করার পর তাঁকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু ১৯৯৮ সালে সোনিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করার পর নতুন সংকটের মুখে পড়ে কংগ্রেস। ১৯৯৯ সালের লোকসবা নির্বাচনের ঠিক আগে শরদ পাওয়ার, পি এ সাংমা এবং তারিক আনওয়ার বিদ্রোহ গোষণা করেন। তাঁদের দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সোনিয়া ঠিক মত গুছিয়ে বসার আগেই ২০০১ সালে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী হন জিতেন্দ্র প্রসাদ। জেতেন অবশ্য সোনিয়াই।
Read the Story in English