/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/07/congress-kamraj.jpg)
ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কংগ্রেস কামরাজের যৌথ নেতৃত্ব ও ঐকমত্য তৈরির পথ থেকে সরে আসে। (ছবি- এক্সপ্রেস আর্কাইভ থেকে)
কংগ্রেসের উপর ইতিহাসের চাপ বড় বেশি। যখনই শতাব্দীপ্রাচীন দলটি সংকটে পড়ে, তখনই তারা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে ইতিহাস থেকে। কামরাজ পরিকল্পনা তেমনই একটি সমাধান। ৫৬ বছর আগে এই জুলাই মাসে কংগ্রেস দল ও সরকারকে নতুন করে শক্তিশালী করার জন্য নেহরুকে পরিকল্পনা বাতলেছিলেন তৎকালীন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী কামরাজ।
কামরাজের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারের নেতৃত্বদায়ী অংশ তাঁদের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব নেবেন, যারা সংগঠনে ছিলেন এতদিন তাঁরা এবার সরকারে আসবেন। ২০১৮ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর রাহুল গান্ধী দলীয় নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কামরাজ পরিকল্পনা ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।
নেহরুর পর কে?
১৯৬৩ সালে পরপর উপনির্বাচনে হারের পর সংকট থেকে উদ্ধার কীভাবে হয়, সে নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু অস্বস্তি শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। আগের বছর চিনের সঙ্গে যুদ্ধ নেতৃত্বের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। নেহরুর অবস্থান সমালোচিত হতে শুরু করে। বিরোধীরা ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছিল, তিনজন বড়সড় বিরোধী নেতা উপনির্বাচনে জিতে লোকসভায় এসেছিলেন। এঁরা হলেন আচার্য কৃপালনি, রামমনোহর লোহিয়া এবং মিনু মাসানি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, নেহরুর পর কে? তখনই কামরাজ নেহরুকে জিজ্ঞাসা করেন, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তিনি সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব নিতে পারেন কিনা। কামরাজের নেতৃত্বে মাদ্রাজে কংগ্রেস নিজেদের শক্তিশালী করতে থাকে, কিন্তু কামরাজ নিজে বুঝতে পারছিলেন ডিএমকে এগিয়ে আসছে, কংগ্রেসের সংগঠনের পক্ষে দ্রাবিড় আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা মুশকিল হতে পারে।
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে বিষয়টি আলোচনার জন্য উঠে আসে। নেহরু মন্ত্রিসভার অনেকে এবং বেশ কিছু মুখ্যমন্ত্রী এ পরিকল্পনা সমর্থন করেন। সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীরা নেহরুর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। নেহরু ৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এঁরা হলেন মোরারজি দেশাই, এস কে পাতিল, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, জগজীবন রাম, কে এল শ্রীমালি এবং বি গোপালা রেড্ডি। এ ছাড়া মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীদের পদত্যাগপত্রও গৃহীত হয়। কংগ্রেসকে পুরুজ্জীবিত করতে এই নেতারা সাংগঠনিক পদ গ্রহণ করেন। এর পর থেকেই কংগ্রেস বিপাকে পড়লেই কামরাড পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলা হয়।
কামরাজ, তাঁর পরিকল্পনা এবং তার পর
কামরাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল দারুণ এবং তিনি ছিলেন একজন হয়ে ওঠা নেতা। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তামিলভাষী এলাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তিনি দলীয় সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং পরে সরকারের দায়িত্বে ছিলেন ৯ বছর ধরে। দরিদ্র পিছিয়ে পড়া নাদার পরিবারের স্কুলছুট কামরাজ কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক থেকে প্রথমে সংগঠনের, পরে সরকারের কর্তৃত্বভার পান। কামরাজের অধীনে মাদ্রাজ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পোন্নত রাজ্যে পরিণত হয়। নেহরু কামরাজকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।
১৯৬৩ সালের ১০ অগাস্ট এআইসিসিতে কামরাজ পরিকল্পনা পাশ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, "একদিকে এ পরিকল্পনার ফলে নেহরু সরকারে ব্যাপক রদবদল করতে পারলেন, অন্যদিকে তেমনই সরকার ও সংগঠনের সম অধিকারের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন।"
যে বছর মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়লেন কামরাজ, সে বছরেরই পরের দিকে কিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে ভুবনেশ্বরে আয়োজিত কংগ্রেসের সভায় দলীয় সভাপতি হিসেবে তিনি যে ভাষণ দেন তা তিনি দিয়েছিলেন তামিল ভাষায়। সেখানে তিনি শ্রেণিদ্বন্দ্বহীন ও কর্তৃত্বহীন এক সমাজবাদী লক্ষ্যের কথা বলেন। অসুস্থ নেহরু এআইসিসির সে সভায় যোগ দিতে পারেননি। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহরু মারা যান।
বিচক্ষণ কামরাজ জানতেন, নেহরুর কোনও বিকল্প নেই এবং দলের প্রয়োজন নয়া নেতৃ্ত্ব, যিনি একই সঙ্গে ক্ষমতা ও দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের সামলাতে পারবেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রী দফতরটিকে মসৃণ করা। এ ব্যাপারে তাঁর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন বিতর্কহীন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। যাঁর পিছনে ছিল দলও। কামরাজের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল দলীয় সংগঠনের এবং সরকারের শক্তিবৃদ্ধি। এবার তিনি দলকে চালনা করলেন নেতৃত্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার বিন্যাস ঘটাতে। জিতে নিলেন অতুল্য ঘোষ, সঞ্জীব রেড্ডি, নিজলিঙ্গাপ্পা এবং এসকে পাটিলের মত নেতাদের বিশ্বাস।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/07/kamraj.jpg)
যৌথ নেতৃত্বের ধারণা
দলের মধ্যে যৌথ নেতৃ্ত্বে আগ্রহ ছিল কামরাজের। নিজেকে তিনি দেখতেন ঐকমত্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তাঁর জীবনীকার তথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রাক্তন সম্পাদক ভি কে নরসীমহন লিখেছেন, সরকারের দৈনন্দিন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কংগ্রেস সভাপতি বা কার্যকরী কমিটির নাক গলানো তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়নের আগে ওয়ার্কিং কমিটিতে সে নিয়ে আলোচনা হোক। মন্ত্রিসভা ও দলীয় সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন কামরাজ।
যৌথ নেতৃত্বের ব্যাপারে কামরাজের এই গুরুত্ব দেওয়ার নীতি খুবই কাজে এসেছিসল, যখন অল্পদিনের মধ্যেই নেহরু ও শাস্ত্রী প্রাণ হারান। দুটি যুদ্ধ ও খরায় তখন দেশের অবস্থা শোচনীয়। বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মোরারজি দেশাইয়ের বদলে ইন্দিরা গান্ধীকে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উত্তরাধিকারী বাছার ব্যাপারে কামরাজের ভূমিকা ছিল মুখ্য।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/07/kemraj-with-nehru.jpg)
পরিকল্পনা নাকচ
ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কংগ্রেস কামরাজের যৌথ নেতৃত্ব ও ঐকমত্য তৈরির পথ থেকে সরে আসে। তার জায়গা নেয় নেতা কেন্দ্রিক হাই কম্যান্ড। শুরু হয় ইন্দিরা সমর্থক ও সিন্ডিকেটের পুরনো প্রহরীদের মধ্যে সংঘর্ষ। যার জেরে ১৯৬৯ সালে পার্টি ভেঙে যায়। ততদিন সংগঠনের উপর থেকে কামরাজের কর্তৃত্ব খর্ব হতে শুরু করেছে, ১৯৬৭ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসকে হারিয়ে দিল ডিএমকে। কামরাজ নিজে পরাজিত হলেন। কামরাজ যদি মুখ্যমন্ত্রী থাকতেন তাহলে মাদ্রাজে কংগ্রেস হারত কিনা সে বিতর্ক অন্য। কিন্তু কামরাজের পরিচালক ভূমিকাহীন মাদ্রাজ কংগ্রেস সরকার ১৯৬৪ সালের হিন্দি বিরোধী আন্দোলন এবং ৬৫-৬৬ সালের খাদ্যাভাবের সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়।
ইন্দিরার সময়কালে কামরাজ পরিকল্পনার সুবিধাগুলি আর নেওয়া যায়নি এবং কংগ্রেস নেহরু-গান্ধী পরিবারকে আবর্তন করেই ঘুরেছে। নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে সভাপতি করার প্রস্তাব দিয়েছেন রাহুল গান্ধী, ফলে ফের সামনে এসে পড়েছে কামরাজ পরিকল্পনার কথা। কিন্তু কংগ্রেস কি এখন কোনও কামরাজ রয়েছেন?
Read the Story in English