কেন্দ্রীয় সরকার এবং বেশ কিছু রাজ্য ১৪ এপ্রিলের পরে যে লকডাউন চালিয়ে যেতে চাইছে, তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। লকডাউনের দু সপ্তাহ পরেও সারা পৃথিবীতে দীর্ঘতম কোয়ারান্টাইন অনুশীলন করবার পরেও কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়বার প্রত্যশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখাচ্ছেন তাঁরা এখনও বৃদ্ধির হার কমেছে বলে দেখতে পাচ্ছেন না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, লকডাউন সমম্পূর্ণ বিফলে গিয়েছে। সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি।
চেন্নাইয়ের ইনস্টিট্যুট অফ ম্যাথমেটিকাল সায়েন্সেসের শিবব্রত সিনহা বলেছেন তিনি আশা করেছিলেন লকডাউনের প্রভাব আগামী দুদিনে দেখা যাবে। তার কারণ, যেখানে সংক্রমিতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই মহারাষ্ট্র সহ অন্তত কিছু রাজ্যে সংখ্যাটা কমতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, লকডাউনের দু সপ্তাহ পরে, এর সুফল পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু এখনও তেমনটা ঘটছে না। কিন্তু রাজ্যওয়ারি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ঘটছে। ৬ এপ্রিলের পর, গত দুদিনে মহারাষ্ট্রে হার কমছে। যদিও এটা বলার পক্ষে একটু বেশি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা নজরে পড়বার মত।
করোনাভাইরাস- মৃত্যুহারই যখন প্রশ্নের মুখে
শিবব্রত আরও বলেন, দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশ (দু রাজ্যেই সংক্রমণ ৩০০-র বেশি)-এও ৩ এপ্রিলের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে এবং সেখানে এটা আরও স্পষ্ট।
কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে বৃদ্ধির হার সরলরৈখিক, এক্সপোনেনশিয়াল নয়।
মডেল দিয়ে যাঁরা হিসেব করেন, তাঁদের কাছে বৃদ্ধিরেখা ফ্ল্যাট হওয়া বা বেন্ড হওয়ার মানে কোনও সংক্রামক রোগের বৃদ্ধির গতি ধীর হচ্ছে। এর অর্থ এই নয় যে রোগ ছড়ানো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এর অর্থ নতুন রোগীতে সংক্রমণের হার কমেছে।
লকডাউনের উদ্দেশ্য ঠিক এটাই ছিল। তিন সপ্তাহ সময় ধরে জনগণের একটা বড় অংশকে বাড়িতে আটকে রেখে, তাঁদের সংস্রবকে সীমিত রেথে এই রোগের বৃদ্ধি কমানো যাবে বলে আশা করা হয়েছিল।একই সঙ্গে এই শ্লথতার সুযোগে সরকারও স্বাস্থ্য পরিষেবা ও হাসপাতাল পরিকাঠামোকে পরবর্তী সম্ভাব্য সংক্রমণ বিস্ফোরণের জন্য সরকার প্রস্তুত করে ফেলতে পারবে বলেও আশা করা হয়েছিল।
“মৌলিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের ব্যাপারে চোখ খুলে দিতে পারে এই মহামারী”
এই প্রভাব দেখা যায়নি। শিবব্রত সিনহা বলছেন, প্রথম তিন জিনের লকডাউনে পরিযায়ীদের যাতায়াত বা নিজামুদ্দিনে তাবলিগি জামাতের জমায়েত এর কারণ নয়। নিজামুদ্দিনের জমায়েত লকডাউন ঘোষণার ১০ দিন আগে ঘটেছে এবং অধিকাংশ যাতায়াতই ততদিনের মধ্যে হয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, ভারতে সংক্রমণের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ এগুলি হলেও, বৃদ্ধিহারে যে কমতি দেখা যাচ্ছে না, এগুলি তার কারণ নয়। পরিযায়ীদের যাতায়াতের ঘটনা ঘটেছে লকডাউনের প্রথম তিন দিনে। ফলে তত্ত্বগত দিক থেকে সে প্রভাব লকডাউন তিনদিন বাড়িয়ে দিলেই অসার হয়ে য়ায়।
শিবব্রত মনে করছেন, সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে বিভিন্ন রাজ্য ও এলাকায় রোগ ছড়ানোর মধ্যে। একটি ভিন্ন গবেষণায় একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন রোগ বৃদ্ধির হার এক এক রাজ্যে এক এক রকম। ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সংক্রমণ ছড়ানোর হার জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা গোটা দেশের অর্ধেক।
আইআইটি দিল্লির গবেষকরা দেখাচ্ছেন একজন কোভিড ১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি ১.৪ জন অন্য ব্যক্তিকে সংক্রমিত করেছেন। এই সংখ্যাটা ১-এর বেশি হলে তা মহামারীর দিকে যাবে। ১-এর কম হলে প্রকোপ দূরীভূত হবে।
যে পাঁচ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, রাজ্যের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি, সেগুলি হল মহারাষ্ট্র (১.৫৮ জন এক জন থেকে সংক্রমিত), তামিলনাড়ু (১.৫৩), দিল্লি (১.৪২), অন্ধ্র্প্রদেশ (১.৫৫) এবং কর্নাটক (১.৪৪)। মধ্যপ্রদেশে রোগীর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি (১৬৫) এবং সংক্রমণের হারও বেশি (১.৫৮), কিন্তু জেলাওয়ারি সংক্রমণের হার কম (১৬ শতাংশ)। কয়েকটি রাজ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা কম হলেও সংক্রমণ ছড়ানোর হার বেশি। এর মধ্যে রয়েচে পশ্চিমবঙ্গ (১,৭), গুজরাট (১.৬১), বিহার (১.৬) এবং ঝাড়খণ্ড (১.৫৮)।
নীতিপ্রণেতাদের কাছে এই সংক্রমক থেকে সংক্রমিতের হারের ব্যাপারটা কেউ যদি জানায়, তাহলে তাঁরা এসম্পর্কে সচেতন হবেন, যে এই মডেলের নানারকম ওঠাপড়া থাকবে। এখন এই মডেলটা দেখলে মনে হচ্ছে এ দেশ মহামারী ছড়াচ্ছে এবং তা দ্রুতগতিশীল। বললেন আইআইটি দিল্লির কম্পিউটেশনলা বায়োলজিস্ট তবপ্রীতেশ শেঠী।
এই মডেলে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে জনঘনত্ব, যাতায়াত, লকডাউন পূর্ববর্তী সংস্রব। গবেষকরা মনে করছেন, লকডাউনের কারণেই সংখ্যা স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।
শিবব্রত সিনহা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে যে মডেল নিয়ে কাজ করছেন, সেখানকার হিসেবে দেখা যাচ্ছে সংক্রমিত থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর হার ১.৮৩ হতে পারে।
১৯ মার্চ শিবব্রতের মডেলে জাতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যাটা ছিল ১.৭। এই হারের হিসেব অনুসারে তাঁর পূর্বানুমান ছিল ভারতে পাঁচ দিনে সংক্রমিতের সংখ্যা হবে ২০০ থেকে ৫০০। ২৪ মার্চে সে সংখ্যা ৫৩০-এর কাছাকাছি হবার কথা।
এর পর থেকে শিবব্রত সিনহার মডেলে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বদল দেখা যায়নি- ৬ এপ্রিলে এই হার ১.৮৩। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে এবার, লক ডাউনের দু সপ্তাহ পর সংক্রমণ ও তা বৃদ্ধির হার কমবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন