Advertisment

এরপর ভাইরাস কোথায় যেতে পারে?

কোভিড ১৯ সংক্রমণের এই পর্যায়ে, যখন লক ডাউন চলছে- সে সময়ে এর পর কী কী হতে পারে, সে দিকে নজর দিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Coronavirus, Vitamin C

ছবি- পার্থ পাল

রবিবার ভারতে করোনাক্রান্তের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়েছে। ৪০ টি দেষের মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। এ দেশে মৃতের সংখ্যা ২৭, ৩০টি দেশে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।

Advertisment

এই সংখ্যা থেকে মনে হতে পারে, ভারতের অবস্থা সুবিধাজনক না হলেও অন্য দেশের থেকে ভাল। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজও নয়। বেশ কিছু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতে আগামী দু মাসে আক্রান্তের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়াবে। অনেকে আবার বলছেন, ইতিমধ্যে দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গিয়েছে, তা ধরা পড়ছে না, কারণ ভারতে তত বেশি পরীক্ষার সুযোগ নেই। আইসিএমআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ) অবশ্য বলছে, এরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি।

বেশ কিছু গবেষণাপত্র আবার বলছে, এ ভাইরাস বেশি তাপমাত্রায় বাঁচে না, এবং সে কারণেই ভারতে সংক্রমণের হার কম। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এক মানবিক সংকট। পরিযায়ী শ্রমিকদের চলাচল শুরু হওয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম লকডাউনের সুবিধা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তাঁরা স্বাস্থ্য নিয়ে বর্তমান উদ্ভূত সংকট সম্পর্কে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতাও রয়েছে। যে ছবিটা উঠে আসছে তা সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু খণ্ড ছবিগুলি জুড়লে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সম্ভাব্য রাস্তা

একটা সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক- এর শেষ কোথায়? নতুন ভাইরাসের প্রকোপ ঘটলে তা ছড়িয়ে পড়া রোধ করবার তিনটি সম্ভাব্য ছবি ভাবা যেতে পারে।

উৎসেই আটকে দেওয়া:

একানে সংক্রমণের প্রতিটি উৎসকে আটকে দিতে হয়। ভারতের ক্ষেত্রে তার অর্থ, প্রত্যেক বিদেশ থেকে আসা ভ্রমণকারীদের চিহ্নিত করা, তাঁদের পৃথক করা- য়াতে সংক্রমণ না ঘটে। অন্যদিকে- দৈনন্দিন নতুন সংক্রমিতদের দৈনন্দিন চিহ্নিতকরণ করা গেলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব না হোক, বিমান আসা বন্ধ ররবার সাতদিন পর তা শ্লথ করা সম্ভব হতে পারত। তেমনটা ঘটেনি।

কমিউনিটি ট্রান্সমিশন:

ভাইরাস যখন কমিউনিটির মধ্যে প্রবেশ করে এবং জনসংখ্যার একটা বড় অংশে সংক্রমণ ঘটায়, তখন এ জিনিস ঘটে। সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণরা মারা যান। কিন্তু তারই মধ্যে মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, যার জেরে ভাইরাসের সংক্রমণ কমে যেতে থাকে ও পরে বিলীন হয়ে যায়। গোষ্ঠী প্রতিরোধের এমনটাই নিয়ম। গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হলে মোটামুটি এমনটাই ঘটে থাকে। জনসংখ্যার কত অংশ সংক্রমিত হবে, তা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে, মূলত নির্ভর করে কত দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তার উপর। গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৬ মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানেন না, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কত দিন ধরে এই সংক্রমণ চলবে। এই প্রক্রিয়া অতীব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে, নির্ভর করে এই ভাইরাস কতটা মারক, তার উপর।

প্রতিষেধক:

এই পরিস্থিতিতে প্রতিষেধক তৈরি হয়, এবং প্রত্যেক ঝুঁকিপ্রবণ ব্যক্তির শরীরে তা দেওয়া হয়। সবদিক হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে এখনও ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগতে পারে। ততদিনে গোষ্ঠীসংক্রমণের গোটা প্রক্রিয়া ঘটে যাবার কথা।

আরও দুটি সম্ভাবনা

তাত্ত্বিক দিক থেকে আরও দুটি সম্ভাবনা রয়েছে।

ভাইরাস বাঁচল না:

কোনও কারণে, যেমন জলবায়ুজনিত কারণে ভাইরাস একটি ভৌগোলিক এলাকায় দী্ঘদিন বাঁচল না, ফলে বড়সংখ্যক মানুষকে সে সংক্রমিত করতে পারল না। কোনও কোনো বিজ্ঞানী উচ্চ তাপমাত্রায় এই ভাইরাসের ক্ষমতা কম হয়ে যায় বলে দাবি করছেন, কিন্তু সে ব্যাপারে এখনও সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না।

পূর্বপ্রতিরোধ ক্ষমতা:

যদি কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে আগে থেকেই এই ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে থাকে তাহলে এমনটা ঘটতে পারে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ভারতের মানুষের পূর্ব প্রতিরোধের কোনও প্রমাণ নেই, যদিও ভারতে এ ভাইরাস অন্য অনেক জায়গার থেকে কম দ্রুত ছড়াচ্ছে।

আরও একটি সম্ভাবনা

অনেক বিজ্ঞানীরাই মেনে নিচ্ছেন যে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঘটনা ঘটবে- ভারতে গোষ্ঠীসংক্রমণের জেরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হবে। এখনও পর্যন্ত যদিও গোষ্ঠীসংক্রমণের খুব কম রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে, তবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা তবুও বলছেন, এমনটা ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি। আইসিএমআর স্বীকার করে নিয়েছে একনও পর্যন্ত গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটেছে বলে মনে করা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটছে। তাঁরা পরিসংখ্যানের উপর ভরসা করছেন না। কীবাবে রোগ ছড়াচ্ছে, এ ব্যাপারে তাঁরা নিজেদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করছেন।

কিন্তু তেমনটাই যদি হয়, কোনও একটা সময়ে গিয়ে সংক্রমণের হার ব্যাপক হবে। যদি তা আটকানোর কোনও পদ্ধতি না নির্ণয় করা হয়, তাহলে খুব দ্রুত বড় সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হবেন।

একবার একটা বড় অংশের মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেলে গোষ্ঠী প্রতিরোধও শুরু হবে, সংক্রমণের হার কমবে। আগেকার দিনে, এভাবেই সংক্রমণ বন্ধ হত। মৃত্যুর সংখ্যা নির্ভর করবে ভাইরাসের প্রকৃতির উপর। যদি ভাইরাস তেমন মারক না হয়, কোনও কোনও মতে বলা হয়, ভাইরাসকে গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া হোক, যাতে গোষ্ঠীপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তবে এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যার একাংশের মৃত্যুকে মেনে নেবার বিষয়টি অতীব সংবেদনশীল একটি বিষয়।

সাবধানতার কারণ

এ ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপারে সরকার দুটি কারণে নারাজ হয়। বর্তমান পৃথিবীতে, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া অতীব অনৈতিক। শেষ পর্যন্ত এতে মৃতের সংখ্যা কমবে জেনেও, একটি ভাইরাসকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া, কোনও সরকারই দেখতে চায় না।

দ্বিতীয় কারণ হল, এর বাস্তব অসুবিধার দিকটি। সংক্রমিত মানুষের অতি সামান্য অংশের (৫-৭ শতাংশের) হাসপাতালে ভর্তি করবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভারতের মত দেশে যদি ব্যাপক সংক্রমণ ঘটে থাকে, তাহলে তার ৫ থেকে ৭ শতাংশকে হাসপাতাল পরিষেবা দেবার মত পরিকাঠামো নেই।

এ কারণেই ২১ দিনের লকডাউন এবং অন্যান্য পদক্ষেপ নেবার কথা উঠছে।

লকডাউনে কী হতে পারে

জনসংখ্যার অধিকাংশকে ঘরবন্দি রেখে এবং অন্য কারও সংস্পর্শে আসতে না দিয়ে রোগ ছড়ানো আটকানো সম্ভব। কিন্তু জরুরি কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, এঁদের বেরোতে দিতেই হবে। এঁরা সংস্পর্শে আসবেনই। ভারতের মত বড় দেশে কিছু মানুষ লকডাউন অমান্য করবেন এবং মেলামেশা করবেনই। যদি এঁদের একটা ক্ষুদ্র অংশও ভাইরাস সংক্রমিত হন, তাহলে তা আরও সম্ভাব্য সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠবে।

লকডাউনের মত পদক্ষেপ যেমন সংক্রমণহারে শ্লথতা আনতে পারে, তেমনই গোষ্ঠীপ্রতিরোধের গতিও কমাতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হল, এই সময়ের মধ্যে প্রশাসন চিকিৎসার ক্ষমতা বাড়াতে পারে, আপৎকালীন পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে যার মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ব্যাপক সংখ্যক রোগী সামলানো যায়।

নিজেদের বন্ধ রেখে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জনতাকে নিশ্চিত করতে হবে যে এই পর্যায়ে হাসপাতালের বেড, আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের সংকট তৈরি না হয়। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এই পর্যায়ে যেন তারা সংকট মোকাবিলায় নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে পারে। সেটা ঘটছেও। বেশ কিছু শহর ও রাজ্যে কোভিড ১৯ রোগীদের জন্য নির্দি্ষ্ট সংখ্যক বেড তৈরি করা হয়েছে। স্টেডিয়ামগুলিকে কোভিড ১৯ রোগীদের হাসপাতাল তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। বিশাল সংখ্যায় মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

অন্য সম্ভাবনা

রেল, বিমান ও বাস চলাচল বন্ধ রেখে সরকার সম্ভবত যাঁরা যেখানে রয়েছেন, তাঁদের সেখানেই রেখে দিতে চাইছে। এর ফলে বহু মানুষ কয়েকশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। এই মানুষগুলির দুর্দশা তো রয়েইছে, এর ফলে লকডাউনের সুবিধাও চ্যালেঞ্জের মুখে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ যাঁরা যে কোনও উপায়ে বাড়ি পৌঁছতে চাইছেন, তাঁদের অনেকেরই মনে হচ্ছে এ রোগ তাঁরা যে শহরে রয়ছেন, সেখানকার- বাড়ি গেলে তাঁরা নিরাপদ। অনেক আবার বলছেন, যদি মরতেই হয় অজানা অচেনা জায়গার থেকে চেনা জায়গায় চেনা মানুষদের মধ্যে মরাই ভাল।

যোগাযোগের সুব্যবস্থা তাঁদের কষ্ট কমাতে পারত। তাঁদের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলা যেতে পারত। শুধু য়াঁরা মরিয়া হয়ে হেঁটে চলেছেন, তাঁরাই নন, যাঁরা ঘরবন্দি হয়ে ক্রমাগত প্যারানয়েড হয়ে যাচ্ছেন যে তাঁদের সংক্রমণ হবে ও তাঁরা মারা যাবেন, তাঁদের উদ্দেশেও কথা বলা যেতে পারত। এঁদের একটু নিশ্চয়তা দেবার দরকার, সরকারের ঊর্ধ্বতম স্তর থেকে তেমনটা হলে সবচেয়ে ভল হয়। তাঁদের বলা দরকার যে তাঁদের যদি সংক্রমণ হয়ও, তাহলে তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও সুস্থ হয়ে যাবেন।

coronavirus
Advertisment