(শেখর সাক্সেনা বর্তমানে হারভার্ড টি এইচ চান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স ইউজের প্রাক্তন ডিরেকটর।জেনিভা থেকে তিনি কথা বলেছেন ময়ুরা জনওয়ালকারের সঙ্গে। জেনিভাতেও এখন লকডাউন চলছে।)
পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপকতম লকডাউন চলছে, ঘরবন্দি বিশ্বের পায় এক পঞ্চমাংশ মানুষ। সদ্য তিন সপ্তাহের লকডাউনের মধ্যে ঢুকলেন ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ। মানসিক ধকল আর অনিশ্চয়তা সারা পৃথিবীর মানসিক স্বাস্থ্যের অভূতপূর্ব হানি ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর জেরে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা ব্যাপক বাড়তে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে এ সময়ে কথা বলে চলা কেন জরুরি?
লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত, মারা গিয়েছেন কয়েক হাজার। ভারতের মানুষ লক ডাউনে। তাঁদের গতিবিধি বদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত, তাঁদের অনেকেই কাজে যেতে পারছেন না। বহু মানুষ বাড়ি থেকে বহু দূরে আটকে পড়েছেন, পরিবহণ নেই, খাবার নেই, টাকা নেই। আমরা বিপদের মধ্যে রয়েছি, এমন বিপদ যার জেরে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, সন্ত্রস্ত, কেউ কেউ এ ব্যাপারটা অন্যদের চেয়ে বেশি অনুভব করছেন। একটা ছবি ভাবুন, যার বাঁদিকে রয়েছে খুব ভাল মানসিক স্বাস্থ্য আর ডানদিকে খুব খারাপ মানসিক স্বাস্থ্য। আমরা সমাজ হিসেবে বাঁদিক থেকে ডানদিকে এগিয়ে চলেছি, যার ফল ভুগছি আমরা সবাই।
জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টি থেকে দেখলে, সামান্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে কোনও বড় সমস্যা- অবশ্যই একটা সমস্যা। কিন্তু বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে যদি সামান্য সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তা ব্যাপকতর স্বাস্থ্য সমস্যা। হ্যাঁ, ভাইরাস একটা সমস্যা। ভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে, মারতে পারে। কিন্তু ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে যদি সামান্য খারাপও হয়ে পড়ে তাহলে প্রতিবন্ধকতা ও পীড়ার দিক থেকে তা গুরুতর সমস্যার হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন, করোনাভাইরাস থাকবে, দীর্ঘদিন লকডাউন রাখা সমস্যা- বলছেন বিশেষজ্ঞ
আপনি লিখেছেন ভাইরাসের কারণে মানসিক যে পীড়া, তার প্রভাব জনস্বাস্থ্যে ভাইরাসের মতই ক্ষতিকর হতে পারে।
সব মিলিয়ে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাস্তব সমস্যা- আর্থিক সমস্যা- রোজগারের সমস্যা- এবং প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা, যার জেরে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও চ্যালেঞ্জের মুখে। একটা বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার কাছে এটা বিশালতর সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।
আমরা সবাই সামাজিক দূরত্বের কথা বলছি। আসলে আমাদের প্রয়োজন শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব নয় - কারণ তা ভুল বার্তা দেয়। বরং এই ধকলের সময়টায় আমাদের অনেক বেশি করে সামাজিক একত্রতার প্রয়োজন, সামাজিক আইসোলেশনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সাপোর্ট।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সমঝোতা না করে এটা যদি সম্ভব হয়, তাহলে তাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। আমাদের বার্তা হওয়া উচিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবার, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নেবার, কিন্তু একই সঙ্গে সামাজিক একত্ববোধেরও - যা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও পালন করা যায়। মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলুন, অন্য মাধ্যমে কথা বলুন, একে অন্যের সমস্যায় সাহায্য করুন, এভাবেই একটা কমিউনিটি একসাথে লড়াই করতে পারে।
সামাজিক দূরত্ব মানে একা হয়ে যাওয়া, যাতে স্ট্রেস বাড়বে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থাগুলি সামাজিক দূরত্ব পালন করবার কথা বলছে, অথচ তাদের বলা উচিত ছিল শারীরিক দূরত্ব বজায় রেথে সামাজিক একত্বের কথা।
আরও পড়ুন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও ধূমপান
অতিমারীর সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট প্রতিরোধে সরকার কী করতে পারে?
জনশিক্ষা ও বার্তাকে খুব খুব স্মার্ট হতে হবে। সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রথম মৌলিক নীতি হওয়া উচিত সঠিক সময়ে যথাযথ বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া।এ ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হলে উদ্বেগ বাড়বে।ভারতে প্রধানমন্ত্রী নিজে কথা বলাটা ভাল উদাহরণ হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সোশাল মিডিয়ায়, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, এমনকি খবরের কাগজেও বহু পরিমাণে ভুয়ো তথ্য ছডানো হচ্ছে, যার কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি নেই এবং যা কার্যত সম্পূর্ণ ভুল। হু একে বলছে তথ্যমারী (infodemic), ভুল তথ্যের মহামারী। ভারত এ ব্যাপারে কুখ্যাত, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তো বটেই। এখন তাদের হাতে অঢেল সময় থাকায় নির্বিচারে এসব তথ্য তারা ছড়িয়ে চলেছে, ভেবে দেখছে না মানুষের উপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে।
এর ফলে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ে, এবং এ জিনিস বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু সরকার একা এ কাজ করতে পারে না, আমাদের সকলে মিলে এ কাজ করতে হবে - প্রামাণ্য কিছু না পেলে আমরা যেন সে মেসেজ ফরোয়ার্ড না করি।
তৃতীয়ত, আমাদের একটু থামতে হবে। সারাক্ষণ ধরে আমরা যেন খবর না দেখে চলি। এতে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বাড়িতে থাকলেও যেন আমরা পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টি পাই এবং আমাদের মনোমত কাজ করি।
দীর্ঘদিন আইসোলেশনে থাকলে কী হতে পারে?
আমাদের জীবনযাত্রায় যে কোনও রকমের বদলের ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়। এটা একটা ব্যাপক, নেতিবাচক পরিবর্তন। সকালে কাজে যাবার জন্য গাড়ি ধরার বদলে আমরা বাড়ি বসে রয়েছি। আমাদের সহকর্মী, বন্ধু এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিবারের মানুষদের থেকেও আমরা বিচ্ছিন্ন। এর ফলে উদ্বেগ বাড়বে।
আমরা এখনও সরাসরি যোগাযোগ রাখতেই পারি এন্যদের সঙ্গে। তাঁরা কেমন বোধ করছেন, আপনি তাদের সাহায্য করতে পারেন কিনা, এসব খোঁজ নিন। হয়ত আপনি বাস্তবে কিছু করতে পারবেন না, কিন্তু তাঁদের কথা শুনুন, তাঁদের সমস্যার শরিক হোন। এটা আমরা খুব ভালোভাবেই করতে পারি। আমরা জানি না যে এ পর্যায় কয়েক সপ্তাহ চলবে নাকি কয়েক মাস, কিন্তু আমাদের দীর্ঘ মেয়াদের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আরও পড়ুন, ২১ দিনের লকডাউনে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের জোগান দিতে ভারত কতটা প্রস্তুত?
আইসোলেশনের ফলে বয়স্ক বা শিশুরা কি আরও অশক্ত হয়ে পড়বেন ?
একবারেই। আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছি যে বয়স্ক মানুষরা আরও বেশি একাকিত্বে ভুগছেন। একাকিত্ব মানুষের স্বাস্থ্যে, মানসিক স্বাস্থ্যে ও আয়ুতে প্রভাব ফেলে। বয়স্ক মানুষরা হয়ত যোগাযোগের আধুনিক মাধ্যমে সড়গড় নন। তাঁদের উদ্বেগ ও স্ট্রেস এমনিতে বাড়বে।
একই ভাবে বাচ্চারে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে অভ্যস্ত, যৌথ পরিবার হলে তাদের ঘিরে থাকেন বড়রা। স্কুল বন্ধ। এটা ছোট বাচ্চাদের কাছে খুবই বড় একটা পরিবর্তন, যারা হয়ত বুঝতেই পারছে না এরকম কেন হচ্ছে। এর ফলে তাদের উদ্বেগও বাড়ছে।
যেসব মানুষ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, তাঁদের সমস্যা হচ্ছে অন্য মানুষদের সঙ্গে সংযোগ নিয়ে, এমনকি প্রয়োজনীয় সামাজিক সাহায্যও তাঁরা হয়ত পাচ্ছেন না। যাঁরা মানসিক ভাবে অক্ষম তাঁদের কোনও না কোনওভাবে উদ্বেগ ও বিচ্ছিন্নতা প্রবল ভাবে বোধ করবেন, ফলে তাঁদের উপসর্গও বাড়বে। যাঁরা শারীরিক বা মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন তাঁদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতেও সংকট হবে।
আপনি বলেছেন মানুষের শারীরিক চলাচল বজায় রাখবার জন্য পার্ক খোলা রাখা উচিত। সেটা কি ভারতের মত ব্যাপক জনসংখ্যার দেশে সম্ভব?
অবশ্যই বড় গ্রুপে জমায়েত হবার সংকট রয়েছে। তেমনটা হতে দেওয়া উচিতও নয়। কিন্তু সমস্ত খোলা জায়গা বন্ধ করে দিলে মানুষ হাঁটতে, জগিং করতে, শারীরিক কসরৎ করতে পারবেন না, যা এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে রয়েছেন। তাঁদের সেখানেই আটকে রাখা একটা অপরাধ। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না করে একটা সমঝোতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
অতিমারীর ফল হিসেবে কী ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মনে হয়?
উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং স্ট্রেস সম্পর্কিত সমস্যা, যেমন নিদ্রাভাব। গবেষণায় প্রমাণিত, কোয়ারান্টিনের সময়ে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা বাড়ে। বেশি ধূমপান, মদ্যপান ও ড্রাগ নেবার ঘটনাও ঘটতে পারে। যখন স্বাভাবিক প্রমোদের ব্যবস্থা থাকে না, তখন অনেকেই ড্রাগ ব্যবহারের রাস্তায় যান।