Advertisment

আদ্যিকালের বিসিজি ভ্যাকসিনই করোনার প্রতিষেধক, দাবি নিউ ইয়র্কের গবেষকদের

টিউবারকুলোসিস (টিবি অর্থাৎ যক্ষ্মা) রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ১৯৪৮ সালে ভারতে সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত হয় বিসিজি, এবং পরে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে এর ব্যবহার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bcg vaccine coronavirus

প্রতীকী ছবি, এক্সপ্রেস আর্কাইভ

যাঁরা ষাটের দশকের (যেসময় স্মলপক্স ভ্যাকসিন বাজারে এল) আগে ভারতে বড় হয়েছেন, তাঁরা জানবেন, ভ্যাকসিন বলতে ছিল একমাত্র বিসিজি (BCG) - বস্তুত, ভারতের প্রথম ভ্যাকসিন এটি। টিউবারকুলোসিস (টিবি অর্থাৎ যক্ষ্মা) রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ১৯৪৮ সালে সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত হয় বিসিজি, এবং পরে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে এর ব্যবহার।

Advertisment

তা এই আদি অকৃত্রিম বিসিজি ভ্যাকসিন কি নভেল করোনাভাইরাস (SARS-CoV2) ঠেকাতেও সক্ষম? এই প্রশ্নের উত্তর গত ক'দিন ধরে খুঁজে চলেছে পৃথিবীর বিজ্ঞান মহল। আলোচনার উৎপত্তি একটি গবেষণা, যেখানে এই দাবি করা হয়েছে, যদিও এই গবেষণা এখনও 'পিয়ার রিভিউ' হওয়ার অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে আরেক দল গবেষক প্রথম গবেষণার দাবিকে খন্ডন করেছেন। আসুন দেখা যাক কী এই ভ্যাকসিন, এবং কীই বা দুই পরস্পর বিরোধী গবেষণার যুক্তি:

ব্যাসিলাস কালমেট-গেরিন (Bacillus Calmette-Guérin বা BCG) ভ্যাকসিন একটি জীবন্ত ক্ষয়িষ্ণু পরিস্রাবণ (strain) যা প্রাপ্ত হয় 'মাইকোব্যাক্টেরিয়াম বোভিস'-এর একটি অংশ থেকে। সারা পৃথিবী জুড়ে টিবি-র ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়েছে এটি। জীবন্ত ক্ষয়িষ্ণু ভ্যাকসিনের অর্থ, এমন একটি প্যাথোজেন-এর ব্যবহার, যার রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা কৃত্রিমভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তবে আবশ্যিক চরিত্র অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যাতে তার বিরুদ্ধে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

বিসিজি ভ্যাকসিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের আড়ালে রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে কীভাবে ভ্যাকসিনের প্রবেশ ঘটল, তার কাহিনী। 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ' পত্রিকায় ২০১৪ সালে 'Brief History of Vaccines and Vaccinations in India' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন লেখেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization বা WHO) সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক চন্দ্রকান্ত লহরিয়া। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, "১৯৪৮ সালের মে মাসে ভারত সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায় যে আমাদের দেশে টিবি মহামারীর আকার ধারণ করছে, এবং যথোচিত বিচার-বিবেচনার পর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই মারণ রোগ প্রতিরোধে সীমিত পরিসিরে বিসিজি ভ্যাকসিন চালু করা হবে। সেই বছরই তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাস) স্থাপিত হয় একটি বিসিজি ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরি। এবং অগাস্ট, ১৯৪৮-এ ভারতে প্রথম এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।”

১৯৫৫-৫৬ সালের মধ্যে এই ভ্যাকসিন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে। আজও ভারত সরকারের ১৯৮৫ সালে চালু হওয়া সার্বজনীন টীকাকরণ প্রকল্পের (Universal Immunisation Programme বা UIP) অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে বিসিজি।

bcg vaccine coronavirus গবেষকদের দাবি, নানাধরনের শ্বাসজনিত রোগের সমাধান করে দেয় বিসিজি ভ্যাকসিন

এই টীকার COVID-19 যোগ আছে না নেই?

নিউ ইয়র্ক ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (NYIT)-র একদল গবেষক COVID-19 ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের বিশ্লেষণ করে তার সঙ্গে বিশ্ব 'বিসিজি অ্যাটলাস' থেকে নেওয়া তথ্য যুক্ত করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে যেসব দেশে সার্বজনীন ভাবে বিসিজি টীকাকরণ হয়, সেসব দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। এর বিপরীতে রয়েছে আমেরিকা বা ইতালির মতো দেশ, যেখানে টিবি প্রায় নির্মূল হয়ে যাওয়ায় সার্বজনীন বিসিজি টীকাকরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

NYIT-র বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের এই গবেষকরা যা লিখেছেন তার সারমর্ম, "ইতালি, যেখানে COVID-19 মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি, সেখানে কোনোদিনই সার্বজনীন বিসিজি টীকাকরণ হয় নি। অন্যদিকে, জাপানে প্রথম থেকেই COVID-19 এর উপস্থিতি সত্ত্বেও, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সব নিয়ম না মানা সত্ত্বেও, মৃত্যুর হার অনেক কম। জাপানে বিসিজি টীকাকরণ চালু রয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে। ইরান, যেখানে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে COVID-19, সেখানে সার্বজনীন বিসিজি টীকাকরণ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, অর্থাৎ ৩৬ বছরের বেশি বয়সী সকলেই অসুরক্ষিত। এবার চিন, যেখানে পঞ্চাশের দশক থেকেই সার্বজনীন বিসিজি টীকাকরণ চালু রয়েছে, সেখানে কীভাবে এতটা ছড়াল করোনাভাইরাস? উত্তর, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দশকে (১৯৬৬-৭৬) সমস্ত টিবি প্রতিষেধক এবং চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি তুলে দেওয়া হয় বা কমজোর করে দেওয়া হয়। আমাদের ধারণা, এর ফলেই সৃষ্টি হয় এমন একদল মানুষের, যাঁরা এই ভাইরাস বহন করবেন এবং তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যদিও বর্তমানে চিনের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে বোধ হয়।"

গবেষকদের দাবি, বহুসংখ্যক শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোগাতে পারে এই ভ্যাকসিন। তবে তাঁরা এও বলছেন যে নভেল করোনাভাইরাস, যার অস্তিত্বের কথা ২০১৯-এর ডিসেম্বরের আগে কারোর জানা ছিল না, আদৌ এই ভ্যাকসিন দ্বারা প্রভাবিত কিনা, তা বোঝার জন্য কিছু 'কন্ট্রোল ট্রায়াল'-এর প্রয়োজন।

তাঁরা আরও লিখেছেন, "দেখা গেছে, বিসিজি ভ্যাকসিন বেশ কিছু সাধারণ সুরক্ষা দেয় বিভিন্ন ভাইরাল সংক্রমণ এবং সেপসিস-এর ক্ষেত্রে, যার ফলে এও সম্ভব যে COVID-19 এর ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ না করলেও, আনুষঙ্গিক সংক্রমণ বা সেপসিস-এর ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। তবে আমরা দেখেছি যে বিসিজি টীকাকরণের সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কম হওয়ার যোগ রয়েছে, সুতরাং এমন হতেই পারে যে COVID-19 এর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু সুরক্ষা প্রদান করে বিসিজি।"

বিরোধী পক্ষের যুক্তি

NYIT-র গবেশনাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ক্যানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে ম্যাকগিল ইন্টারন্যাশনাল টিবি সেন্টারের গবেষকরা একটি লিখিত প্রতিক্রয়া দেন, যাতে এই গবেষণার প্রণালী, যেসময় গবেষণাটি করা হচ্ছিল তখন বিশ্বে করোনাভাইরাসের বিস্তার, এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিসিজি এবং করোনাভাইরাসের সংযোগের পিছনে আর কোনও ব্যাখ্যা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম, "যে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছে যে, শতাব্দী-প্রাচীন এক ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা, এবং কিছু অনির্দিষ্ট অসুখের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করার ক্ষমতা তাকে COVID-19 এর বিরুদ্ধেও কার্যকরী করে তুলতে পারে, শুধুমাত্র সেই বিশ্লেষণ ধরে চললে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। এই বিশ্লেষণ বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নিলে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঢিলেমি আসতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন- এবং মধ্যম-আয়ের (low and middle-income countries বা LMIC) দেশগুলিতে। ইতিমধ্যেই এরকম বেশ কিছু দেশের সংবাদমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিপদকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। ভারতের মতো দেশে, যেখানে সার্বজনীন টীকাকরণ প্রকল্প চালু রয়েছে, সেখানে এই ধরনের তথ্য এক মিথ্যা নিরাপত্তার আবহ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে আসল কাজে ঢিলেমি আসার সম্ভাবনা।"

ম্যাকগিল-এর গবেষকদের আরও বক্তব্য, NYIT যে সময় করোনাভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে, বিশ্বের অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে তখনও এই হারে ছড়িয়ে পড়েনি COVID-19; তাঁদের লেখায় বলা হয়েছে, "উদাহরণস্বরূপ, ভারতে COVID-19 আক্রান্তের সংখ্যা ২১ মার্চে ১৯৫ থেকে বেড়ে ৩১ মার্চে হয়ে যায় ১,০৭১। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২১ মার্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০৫, ৩১ মার্চ তা হয়ে যায় ১,৩২৬।" উল্লেখ্য, শুক্রবার পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২,৫০০ ছাড়িয়ে যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া'র সভাপতি ডাঃ কে এস রেড্ডি বলছেন: "যেসব দেশে দীর্ঘমেয়াদী এবং অব্যাহত বিসিজি টীকাকরণের চল রয়েছে, সেখানে COVID-19 মহামারীর তীব্রতা হ্রাসের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেখানে এই ধরনের প্রকল্প নেই বা দেরিতে শুরু হয়েছে, তাদের তুলনায়। কোনও সরাসরি অ্যান্টি-ভাইরাল প্রভাব নেই, কিন্তু 'immuno-potentiator' বা সম্ভাব্য প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে বিসিজি, যার ফলে করোনাভাইরাসকে হয়তো একটু সহজে ঠেকাতে পারবে শরীর। তবে আরও জোরালো প্রমাণ দরকার, যা হয়তো কিছু দেশে শুরু হওয়া পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে উঠে আসবে।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment