দেশে নোভেল করোনাভাইরাসের থাবায় এখনও পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১১ লক্ষ মানুষ। ভারতের প্রতিটি রাজ্য, এমনকী কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল এবং দ্বীপপুঞ্জগুলিও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপ যেখানে জনসংখ্যা খুবই কম সেখানেও আক্রান্ত হয়েছে ১৫০ জন। প্রশ্ন উঠছে সেখানেই। তবে কি দেশে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে?
সম্প্রতি মোদী সরকারের তরফে বেশ কিছুটা জোর দিয়েই বলা হয়েছে যে এখনও করোনা সংক্রমণ সেই উচ্চতায় পৌঁছয়নি যেখানে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হতে পারে। কিন্তু দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা জানান, এই দাবি সত্য নয়। সরকারের অবস্থান সঠিক নয়। করোনা থাবায় ইতিমধ্যেই গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এর গুরুত্ব যে মারাত্মক কিছু তেমনটা নয় বলেই বিজ্ঞানী মহলের মত।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণ আসলে কী?
গোষ্ঠী সংক্রমণ বলতে বোঝানো হয় যখন কোনও রোগ বা বলা ভালো অতিমারী একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে এবং তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কোনও রোগের গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হলে তা নির্মূল করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। কারণ কোন জনের থেকে কার দেহে ছড়িয়ে পড়ছে তা বোঝা দুষ্কর। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে 'চেইন রি-অ্যাকশন' ও বলা হয়। সেক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় তা হল যাদের দেহে রোগটি ধরা পড়ছে তাঁদেরকে চিহ্নিত করা। এরপর পরীক্ষা করে রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁদের আইসোলেট করে রাখা। তাহলেই রোখা যায় গোষ্ঠী সংক্রমণ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এই করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশ থেকে যারা এসেছেন তাঁদের সংস্পর্শেই এই রোগের বিস্তার হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই মত প্রকাশ করেছে চিকিৎসামহল। প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারা যায়নি কে 'প্রাইমারি সাসপেক্ট' কে 'সেকেন্ডারি'। এখন দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লক্ষ। বিজ্ঞানীদের মত এখনও যদি সরকার বলে যে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়নি, তবে তা 'হাস্যকর' এবং 'অসত্য' ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহেই স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে বলা হয়, 'কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়ে এখন কোনও কথা বলা উচিত নয়।"
তবে দেশে ঠিক কী হচ্ছে? কী পরিস্থিতি?
বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়েছে। আইআইএসইআর পুনের ইমিউনোলজিস্ট এবং প্রফেসর বিনীতা বল জানান, "সরকারের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কোনও এপিডেমিওলজিস্টকে জিজ্ঞেস করুন করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণের বিষয়ে। তিনিও এটাই বলবেন যে হ্যাঁ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। সরকার কেন এ বিষয়ে অনড় আমি তা জানি না। এখন নয়, প্রথম থেকেই এই অবস্থানে রয়েছে তারা। কিন্তু কেন? আমার অন্তত জানা নেই।"
এই প্রেক্ষাপটে একজন বর্ষীয়াণ বিজ্ঞানী, যিনি রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে উপদেষ্টা পদে রয়েছেন, তিনি বলেন, তাঁদের কাছে তথ্য এবং প্রমাণ সবই রয়েছে যা গোষ্ঠী সংক্রমণের বিপক্ষে কথা বলছে। আর এটাই বাস্তব। এটা আজ নয়, অনেকদিন আগে থেকেই বলা হয়েছে বলেই জানান তিনি।বিজ্ঞানী বলেন, "আমাদের টিম একদম নিখুঁত ডেটা নিয়ে কাজ করছে। আর সেখানে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। চেইন রি-অ্যাকশন এখনও কোথাও দেখা যায়নি। আমি যেটা বলছি সেটা একেবারেই তথ্য নির্ভর। আমি মানছি যে দেশে ১১ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেটা গোষ্ঠী সংক্রমণের জন্য হয়েছে।" তবে বিজ্ঞানী বলেন যেহেতু তিনি সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছেন তাই তিনি সেই ডেটা উল্লেখ করতে পারবেন না।
ভারতের একটি হেলথ রিসার্চ সংস্থার ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামালের অবশ্য মত সরকারের তথ্য অস্বচ্ছতা স্পষ্ট। তিনি বলেন, "আমার মনে হয় এটা এমন একটা বিষয় যেখানে সকলের পরিস্কার তথ্য জানা উচিত। ১০ লক্ষ আক্রান্ত পেরিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কাউকে দোষারোপ করা হচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে ভারতের যে জনসংখ্যা সেই বিচারে এখনও পরিস্থিতি খুব খারাপ নয়। কিন্তু ১০ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি, এটা কি করে সম্ভব? আইসিএমআর যে সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল সেখানে দেখা গিয়েছে ৪০ শতাংশ কেসে বোঝা যায়নি কোথা থেকে এই রোগ এসেছে তাঁদের দেহে? এরপরও সরকার বলবে গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি?"
তাহলে কেন সরকার স্বীকার করছে না?
বিজ্ঞানীদের মত সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ভেলোর সিএমসি হাসপাতালের প্রাক্তন প্রধান জয়প্রকাশ মুলিয়িলের কথায়, "আমি জানি না সরকার কেন এই বিষয়টিকে স্বীকার করছে না। আমার যেটা মনে হচ্ছে তা হল, সরকার যদি স্বীকার করে নেয় তাহলে এই সব কনটেনমেন্ট জোনের কোনও অর্থই থাকবে না। মানুষ তো জানতে চাইবে যে যদি গোষ্ঠী সংক্রমণই হয়ে থাকে তবে তারা কেন কনটেনমেন্ট জোন মানবেন? এই ধরনের অবস্থা এড়ানোর জন্যই সরকার এমনটা করছে।"
সত্যি কি কিছু যায় আসে স্বীকার করলে?
ভেলোরের হাসপাতালের প্রধানের মতে, সরকার যদি স্বীকার করে নেয় গোষ্ঠী সংক্রমণের কথা তাহলে কিছু যায় আসবে না। কারণ এটি বিশেষ কিছু বিষয় নয়। এটা কেবল এক সংক্রমণের একটি ধরণ। বিজ্ঞানীদের মতে কিছুই বদলাবে না সরকার বিষয়টি স্বীকার করলে। একই ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মেও বদল হবে না।
Read the story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন