Advertisment

করোনাভাইরাসের আগে ভারতে মহামারীর খতিয়ান

করোনাভাইরাসের সংক্রমিতের সংখ্যা এ দেশে ১৭ মার্চ, বুধবার ১৩৫ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা এখন তিন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pandemic, Coronavirus

ভারতে এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ৩

ভারতে বহুবার নানারকম অসুখ দেখা গিয়েছে, দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবও, তার মধ্যে রয়েছে ২০০২-২০০৪-এর সার্সের প্রকোপ। কিন্তু ১৯৯০ থেকে পরিসংখ্যানের হিসেবে কোভিড-১৯-এর মত ব্যাপক ভাবে দেশের সর্বত্র  রোগ ছড়িয়ে পড়বার ঘটনা আগে দেখা যায়নি।

Advertisment

মহামারী

২১ শতকে জন্ম নেওয়া বহু ভারতীয় নাগরিক দেশের জনসাধারণের মধ্যে কোনও রোগের প্রাদুর্ভাবের সাক্ষী নন, যে অভিজ্ঞতা তাঁরা কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে দেখছেন। ব্যতিক্রমী কয়েকটি ঘটনা ছাড়া, সারা দেশের মধ্যে মহামারী ও জনস্বাস্থ্য সংকট ভারতে বিরল বললেই চলে। ১৯০০ সাল থেকে ভারতে যেসব মহামারী হয়েছে, তার একটা খতিয়ান দেওয়া হল।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ একবার সারার পর ফের হতে পারে?

১৯১৫-১৯২৬ - এনসেফালাইটিস লেথারজিকা

১৯১৫ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে এনসেফালাইটিসের মহামারী দেখা যায়। এ রোগে দুর্বলতা, কাজে অনীহা, ঘুমঘুম ভাব সহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যেত। ১৯১৯ সালের মধ্যে সারা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, মধ্য আমেরিকা ও ভারতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

১৯২৯ সালের জুলাই মাসে ভারতীয় চিকিৎসক জে ই ধুঞ্জিভয় তাঁর প্রকাশিত গবেষণায় এ রোগকে অতি সংক্রামক বলে বর্ণনা করেন, যেখানে ভাইরাসের সংক্রমণ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও ধূসর কোষকে আক্রান্ত করে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ১৯১৭ সালে ইউরোপে এ রোগ ছড়িয়ে পড়বার আগে ভিয়েনায় প্রথমবার তা দেখা যায়। পূর্বোক্ত গবেষণাতেই বলা হয়েছে, নাক ও মুখ নিঃসৃত তরলের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ লক্ষ মানুষ এই রোগে মারা যান।

১৯১৮-১৯২০ স্প্যানিশ ফ্লু

এনসেফালাইটিস থেকে মুক্তির আগে এসে গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। এই মহামারীর প্রকোপ হয় আভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। এ রোগে মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট থাকলেও ধরে নেওয়া হয় সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিলেন। ভারতে ১০-২০ মিলিয়ন মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান এই অতিমারীর সময়ে মানুষ সামাজিক দূরত্ব রাখা ও সীমিত ভ্রমণের মত বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

হাত ধোয়ার কথা যে চিকিৎসক প্রথমবার বলেছিলেন

১৯৬১-১৯৭৫- কলেরা অতিমারী

১৮১৭ সাল থেকে কলেরার অতিমারী শুরু হয়। মোট সাতবার এই অতিমারী চলে। ১৯৬১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সপ্তমবার এই অতিমারী দেখা গিয়েছিল। পাঁচ বছরের কম সময়ের ব্যবধানে এই ভাইরাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অবিভক্ত ভারতে এ রোগ পৌঁছয় ১৯৬৩-৬৪ সালে। গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলে কলকাতার অবস্থান, সেখানকার জলবায়ু এবং জল পরিষ্কার না রাখার অভ্যাসের কারণে কলকাতা হয়ে ওঠে এ রোগের চারণ ক্ষেত্র।

দক্ষিণ এশিয়া থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে।

১৯৬৮-১৯৬৯ - ফ্লু অতিমারী

এই জীবাণুর আক্রমণ প্রথমবার ১৯৬৮ সালে হংকংয়ে দেখা গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। সারা পৃথিবীতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে অল্প দিনের মধ্যেই। জুলাইয়ের শেষাশেষি ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে এই রোগের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। দু মাসের মধ্যে তা ফিলিপিন্স, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম থেকে ফেরা সৈনারা আমেরিকায় এ রোগ বহন করে নিয়ে আসেন। প্রথম কয়েক জনের সংক্রমণ ধরা পড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সে বছর ডিসেম্বরের মধ্যে, গোটা আমেরিকায় রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালে জাপান, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় এই রোগ ছড়ায়। এক বছরের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয় এই রোগে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর পিছনে কেন দায়ী করা হচ্ছে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে?

১৯৭৪ - গুটি বসন্তের মড়ক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে সরকারি ভাবে গুটি বসন্ত নির্মূল হয়েছে। এ রোগের উৎস ঠিকঠাক জানা না গেলেও মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। ভারতে কবে এ রোগ প্রম দেখা গিয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। ১৯৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুটি বসন্ত নির্মূল করতে পদক্ষের নেয়, এবং বহু অর্থ খরচ হলেও সারা দুনিয়া জুড়েই তাতে সাড়া পড়েছিল।

১৯৬৬ সালের মধ্যে ২২ টি দেশে গুটি বসন্ত সম্পূর্ণ নির্মূল হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলের মত কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বিশ শতকেই এই রোগে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

১৯৯৪- সুরাটের প্লেগ

১৯৯৪ সালে সুরাটে নিউমোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। গুজব ও অসত্য খবরের জেরে শুরু হয় কালোবাজারি, সর্বসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ ভয়ে শহর ছাড়তে শুরু কেরন, যার জেরে দেশের অন্যত্রও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ১০০০ জন আক্রান্ত হন, মারা যান ৫০ জন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ: বাড়িতে অন্তরীণ থাকার নিয়ম কী?

২০০২-২০০৪ - সার্স

একুশ শতকের সর্বপ্রথম ভয়ংকর সংক্রামক রোগ হল সার্স। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে ভারতে প্রথম সার্সের খোঁজ মেলে। মনে করা হয়, তিনি সিঙ্গাপুরে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কোভিড-১৯-এর মতই এই রোগের কারণ ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস। দু বছরে ভারতে তিনজন সার্স রোগীর খোঁজ মেলে। এই ভাইরাস পৃথিবীর ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

২০০৬- ডেঙ্গি ও চিকুনগুনিয়া

ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ২০০৬ সালে ডেঙ্গি ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। আক্রান্ত হন আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারাও। এ দুই রোগই মশাবাহিত। বদ্ধ জলে মশার লার্ভা থেকে এই রোগ স্থানীয় ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা যায় তামিল নাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও দেশের অন্য কিছু রাজ্যেও। সে বছরই দিল্লি, রাজস্থান, চণ্ডীগড়, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সর্বাধিক আক্রান্তের পরিমাণ ছিল দিল্লিতে। সারা দেশে সে বছর ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয় ৫০ জনের।

২০০৯ - গুজরাটে হেপাটাইটিস

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাটের মোদাসায় হেপাটাইটিস বি-তে ১২৫ জন আক্রান্ত হবার খবর মেলে। এঁদের সকলেরই লিভারে সংক্রমণ ঘটেছিল। দূষিত রক্ত শরীরে গেলে এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। স্থানীয় চিকিৎসকরা সন্দেহ করেন, ব্যবহৃত, দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের ফলেই এঁদের এই সংক্রমণ ঘটেছে।

২০১৪-১৫ - ওড়িশায় জন্ডিস

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওড়িশার বেশ কয়েকটি শহরে জন্ডিসের প্রকোপ দেখা গেয়। প্রথম আক্রান্তের খবর এসেছিল সম্বলপুর থেকে। তিন মাসের মধ্যে অন্তত ৬ জন মারা যান, আক্রান্ত হন ৬৭০ জন। গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছন নর্দমার জলের পাইি থেকে দূষিত জল পানীয় জলের পাইপে মিশে যাওয়ায় এই সংক্রমণ ঘটে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংলগ্ন শহর এবং জাজপুর, খোড়ডা ও কটকেও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। সারা রাজ্যে মোট ৩৯৬৬ জন আক্রান্ত হন। সরকারি হিসেবে এ রোগে ৩৬ জনের মৃত্যু ঘটে।

২০১৪-১৪ - সোয়াইন ফ্লু

২০১৪ সালের শেষ কয়েক মাসে H1N1 ভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও তেলেঙ্গানায় এই রোগ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভারতে ১২৯৬৩ জনের সংক্রমণ ও ৩১ জনের মৃত্যুর খবর আসে। দেশের অন্যত্রও এই ভাইরাস ছড়ায়, যার জেরে ভারত সরকার জনসচেতনতা প্রসারের বন্দোবস্ত করে। ২০১৫ সালের মার্চের মধ্যে সারা দেশে ৩৩ হাজার সংক্রমণের খবর আসে এবং ২০০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

২০১৭ - এনসেফালাইটিস প্রাদুর্ভাব

উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে এনসেফালাইটিসের পূর্ব ইতিহাস থাকলেও, ২০১৭ সালে বেশ কয়েকজন শিশুর এনসেফালাইটিসে মৃত্যু ঘটে।  জাপানি এনসেফেলাইটিস ও অ্যাকিউট এনসেফালাইটিস সিনড্রোমের কারণ মশার কামড়। এই দুই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হতে পারে যার জেরে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

গোরখপুরে এই প্রাদুর্ভাবের কারণ ছিল পরিচ্ছন্নতা ও শৌচ ব্যবস্থার অভাব। কিছু জেলা হয়ে উঠেছিল মশার বিচরণভূমি। বিষয়টি পরে আরও জটিল হয়ে ওঠে। রাজ্যের এক হাসপাতালে, যেখানে শিশুদের চিকিৎসা হচ্ছিল, সেখানে অক্সিজেন সাপ্লায়ারের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য টাকা না মেটায় অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার জেরে মারা যায় অনেকসংখ্যক শিশু। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৩০০-র বেশি শিশু মৃত্যু ঘটে।

২০১৮- নিপা ভাইরাস

২০১৮ সালের মে মাসে কেরালায় ফলখেকো বাদুড়ের থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। কয়েকদিনের মধ্যেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথা ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। কেরালা সরকার বেশ কিছু প্রতিষেধক পদ্ধতি গ্রহণ করে।

এই রোগ মূলত কেরালা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন ও নেতৃত্বের সহায়তায় এই রোগ রাজ্যের বাইরে ছড়াতে পারেনি। ২০১৮ সালের মে জুনের মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু ঘটে। জুন মাসে এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।

coronavirus
Advertisment