কোভ্যাক্সিন। ভারতে তৈরি। একটি শিশুও জানে এই তথ্য। ভারতের গর্বের এই ভ্যাকসিন। কোটি কোটি মানুষের ভরসাস্থল। তবে ওই একটি শিশুর মনেও প্রশ্ন, এই টিকা কতটা কার্যকরী। তারই পোক্ত তথ্য সামনে এসেছে। তৃতীয় পর্যায় বা ফেজ থ্রি ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে কোভ্যাক্সিনের গুণ বলা যেতে পারে আঠেরো আনার মধ্যে ষোল আনা।
কী রকম? তথ্য বলছে, উপসর্গ-থাকা কোভিডে ৭৭.৮ শতাংশ সুরক্ষা দিতে এই ভ্যাকসিন সক্ষম। এই খবরটা এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিনটি ব্যবহারে ছাড়পত্র পাওয়ার ঠিক একদিন পর। বলা বাহুল্য, তবুও বলতে হচ্ছে যে, WHO ১৮ এবং তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারের এই ছাড়পত্রটি দিয়েছে। আপাতত, জোড়া সুখবরে কোভ্যাক্সিনে সুবাতাস এসে লেগেছে। এর আকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক দিনের।
ট্রায়ালে যা মিলল
এই ট্রায়ালে অর্থ জুগিয়েছে ভারত বায়োটেক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ বা আইসিএমআর। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে এটি চলেছে ২০২১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত। ২৫ হাজার ৭৯৮ জন এই ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৪১৯ জন দুটি ডোজ নিয়েছেন। এঁদের বাছাই করা হয়েছে যদৃচ্ছ ভাবে। সারা দেশের ২৫টি হাসপাতাল থেকে এঁদের কোভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে।
এফিকেসি বলে একটি কথা কোভিড ভ্যাকসিন কালে খুবই প্রসিদ্ধ হয়েছে। এফিকেসি মানে, কার্যকারিতা। কাউকে ভ্যাকসিন দিলে, তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা তৈরি হবে, এফিকেসি মানে তা-ই। ট্রায়ালের মাধ্যমে সেই এফিকেসি রেটের সুস্পষ্ট ছবিটাই সামনে আসে, এসে যায়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে। এখানে আরেকটা কথা বলে নিতে হবে। সাধারণত এই ধরনের ট্রায়ালে ভল্যান্টিয়ারদের দুটি দলে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি দলকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, আর একটি দলকে ভ্যাকসিনের নামে নির্দোষ যেমন চিনির জাতীয় কিছু দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, এটা করা হয় গ্রহীতাদের একেবারে অজান্তে।
শুধু ভ্যাকসিন নয়, কোনও ওষুধের এফিকেসি পরখ করে দেখার জন্যও এই পদ্ধতি নেওয়া হয়ে থাকে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রথম গ্রুপটিকে ভ্যাকসিন গ্রুপ বলে, দ্বিতীয়টিকে প্লেসিবো গ্রুপ বলা হয়। শুরুতে ভোডিড নেগেটিভ থাকা ১৬ হাজার ৯৭৩ জনের মধ্যে ট্রায়ালপর্বের পর ১৩০ জনের সিম্পটোম্যাটিড কোভিড বা উপসর্গযুক্ত কোভিড কেস সামনে আসে। এই তথ্য নেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার অন্তত দু'সপ্তাহ পর। এর মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রুপে (৮,৪৭১ জন) ২৪ জন পিজিটিভ হয়েছেন এবং প্লেসিবো গ্রুপে (৮,৫০২ জন) পজিটিভ ১০৬ জন। এ থেকেই ফুটে উঠেছে কোভ্যাক্সিনের এফিকেসি রেট। যা ৭৭.৮ শতাংশ।
পজিটিভ কেসের মধ্যে ১৬ জনের প্রবল উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। সিভিয়ার সিম্পটোম্যাটিক ওই রোগীদের মাত্র ১ জন পড়েছেন ভ্যাকসিন গ্রুপে, বাকি সকলেই প্লেসিবো-তে ছিলেন। ফলাফল থেকে জানা গিয়েছে, কোভিডের বিরুদ্ধে শরীরে যথেষ্ট অ্যান্টিবডির জন্ম দিতে পারে কোভ্যাক্সিন। ভ্যাক্সিনের কুপ্রভাব কিংবা মৃত্যু হয়নি ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের কারওরই। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর অবশ্য বেশির ভাগেরই মাথা-ধরা, দুর্বলতা, গা-ব্যথা বা জ্বর এসেছে। তবে তার প্রকোপ ছিল মৃদু, এবং তেমনটা দেখা গিয়েছিল ভ্যাকসিন নেওয়ার সাত দিনের মধ্যে।
কোভিশিল্ড এবং এফিকেসি
কোভ্যাক্সিনের পাশাপাশি, কোভিশিল্ড এবং স্পুটনিক-ভি দেওয়া হয়েছে এ দেশে। যদিও স্পুটনিক পেয়েছেন খুবই কম সংখ্যক। কোভিশিল্ড হল, এতদিনে যা সকলেই জেনে গিয়েছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ভার্সন। নামী বিজ্ঞানের জার্নাল ল্যানসেটে এই ভ্যাকসিনের এফিকেসি সম্পর্কে লেখা ছাপা হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে, যা আপডেট করা হয়েছে এ বছরের মার্চে। এটির এফিকেসি রেট হল-- উপসর্গযুক্ত কোভিডের বিরুদ্ধে ৮১.৩ শতাংশ। ট্রায়ালে এই প্রতিষেধকের দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছিল ১২ সপ্তাহের ফারাকে।
কোভ্যাক্সিন এবং ডেল্টা
কোভ্যাক্সিন স্টাডিতে গবেষকরা দেখেছেন এই ভ্যাকসিনের এফিকেসি রেট ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে কিছুটা কম হচ্ছে। উপসর্গযুক্ত ডেল্টা-র থেকে এই ভ্যাকসিন প্রতিরোধ তৈরি করতে পারছে ৬৫ শতাংশ। তবে এই তথ্য প্রাথমিকতা থেকে সঞ্জাত, আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
সীমাবদ্ধতা
কোভ্যাক্সিনের এফিকেসি বা কার্যকরিতা গবেষণায় একটি স্পষ্ট ছবি প্রকাশ পেলেও, আরও বড় আকারে জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পরীক্ষা করলে তবে ফলাফলের খুঁত অনেক কম হবে। পারফেকশনের নিকটবর্তী হয়ে উঠবে ফল। বলছেন গবেষকদের অনেকে। তা ছাড়া একটি ডোজ নেওয়ার পর এই ভ্যাকসিনের এফিকেসি কত, সেটি গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসেনি। ডেল্টা এবং আলফা ইত্যাদি ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে কোভ্যাক্সিনের সম্পর্কের সিংহ ভাগটাই ধোঁয়া-গহ্বরে রয়েছে তদুপরি। কারণ, গবেষণা সামান্যই আলো দিতে পেরেছে তাতে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন