আপনি যদি আক্রান্ত হন: কোভিড-এর দেখভাল ও চিকিৎসা

যেসব গোষ্ঠী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মশলার গুঁড়ো, আর্সেনিকাম অ্যালবাম বা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন না দিয়ে এখন বরং পালস অক্সিমিটার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

যেসব গোষ্ঠী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মশলার গুঁড়ো, আর্সেনিকাম অ্যালবাম বা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন না দিয়ে এখন বরং পালস অক্সিমিটার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Covid-19 care

অতিমারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে কয়েক দশকের অবহেলা ঠিক করে ফেলা যায় না

(ডক্টর সতচিৎ বালসারি হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অ্যান্ড পাবলিক হেলথ স্কুলের এমার্জেন্সি মেডিসিন ও গ্লোবাল হেলথের অধ্যাপক। ডক্টর জারির উদওয়াজিয়া মুম্বইয়ের পিডি হিন্দুজা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের বক্ষ বিশেষজ্ঞ)

Advertisment

তিন মাস ধরে বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের পর, সম্ভবত একটা ঐকমত্যে পৌঁছনো গিয়েছে বা বিলম্বিত বোধোদয় হয়েছে - যে সব কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার দরকার নেই। মার্চের শুরু থেকেই আমরা নিশ্চিতভাবে জেনে গিয়েছিলাম যো কোভিড-১৯ ইবোলার মত ছড়ায় না, এবং এর বিরুদ্ধে সেরা প্রতিরক্ষা হল হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। তা সত্ত্বেও প্রায় ১০০ দিন ধরে ভারতের বিভিন্ন শহরে কোভিড-১৯ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হল, তাঁদের রোগের প্রাবল্য বিবেচনা না করেই।

এই ভুল, যার কোনও ওজর হয় না, তার জেরে প্রথমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হল এবং শেষে ভেঙে পড়ল। হাজার হাজার অ-কোভিড রোগীদের যত্ন নিতে পরিকাঠামো অসফল হল, কাজের অতিরিক্ত চাপে কর্মীদের সুস্থতা বিপর্যস্ত হল। এ সময়ে, যখন এই অতিমারী দেশের পশ্চাদভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন এ থেকে কী শিখল ভারতের অন্য নগর, শহর ও গ্রামগুলি?

কোভিড-১৯-এর সংস্পর্শে এলে কী কী হতে পারে তার সংখ্যাগত নির্দিষ্টতা রয়েছে। এই সম্ভাবনাগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক, তারই সঙ্গে দেখে নেওয়া যাক প্রতিটি সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে কী ধরনের দেখভাল করা যেতে পারে।

Advertisment

উপসর্গবিহীন- সংস্পর্শে এলে কারও কোভিড-১৯ হতে পারে, কারও না হতেও পারে। যাঁদের হবে, তাঁরা মূলত উপসর্গবিহীন হবেন। তবে তাঁদের উপসর্গ না থাকলেও তাঁরা রোগ ছড়াবেন। যাঁরা খুব কাশছেন, তাঁদের তুলনায় এঁরা সংক্রমণ হয়ত কম ছড়াবেন, কিন্তু উপসর্গবিহীনরা রোগ ছড়াবেন না, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে এঁদের কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।

উপসর্গপূর্ব ও সামান্য সংক্রমিত- যে সামান্য কয়েকজন সংক্রমিত হবেন, তাঁরা সকলেই শুরুতে উপসর্গপূর্ব হবেন। মাঝে দুদিনের মত সময় পাওয়া যাবে, তার পরেই তাঁরা সংক্রামক হবেন, ভাইরাস ছড়াবেন, কিন্তু তাঁদের উপসর্গ দেখা যাবে না। ক্রমশ তাঁদের কোভিড-১৯ -এর একটা বা একাধিক ফরসর্গ দেখা দেবে, স্বাদহানি, কাশি, জ্বর বা অন্য কিছু।

এই উপসর্গযুক্তদের অধিকাংশের উপসর্গ হবে মৃদু এবং তাঁদেরও কোনও চিকিৎসা প্রয়োজন হবে না, যদি না ডাক্তার তাঁদের উপসর্গের মোকাবিলা করতে বলেন, যেখানে জ্বর বা কাশি বা গায়ে ব্যথার ওষুধ দেওয়া হবে। এসব ক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসাও কাজে লাগতে পারে, তবে সে সবের ফলে এই রোগ সেরে গিয়েছে, তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি।

মাঝারি উপসর্গযুক্ত- অবশিষ্টদের মধ্যে কারও কারও মাঝারি উপসর্গ দেখা দেবে, কারও ক্ষেত্রে ব্যাপক ফরসর্গ দেখা দেবে। এই দু ধরনের ক্ষেত্রে উন্নত মানের চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।

কিন্তু মূল চিকিৎসা তাঁদেরই প্রয়োজন, যাঁদের অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা মাঝারি রকমের, যা মূলত অক্সিজেন প্রদানের মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। পোর্টেবল অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে রোগীকে মাস্ক পরিয়ে টিউবের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়ে থাকে, বা কিছু হাসপাতালে থাকে পাইপড অক্সিজেন, বা অক্সিজেন কনসেনট্রেটর নামের একটি মেশিন থেকেও অক্সিজেন দেওয়া হয়ে থাকে যা বাতাস থেকে অক্সিজেন প্রস্তুত করতে পারে। ফুসফুস সংক্রান্ত রোগীরা অনেকেই বাড়িতেই এ ব্যবস্থা রাখেন। এঁদের আইসিইউ তে ভর্তি করার কোনও কারণ নেই। তাঁদের ভেন্টিলেটর প্রয়োজন নেই, ইন্টেন্সিভ কেয়ার স্পেশালিস্টের প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে ভারতের কোনও শহরেই এ ব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে নেই, ছোট শহর বা গ্রামগুলির তো কথাই ওঠে না।

তীব্র সংক্রমণ- সাধারণ নিউমোনিয়ার কেস ছাড়াও আমরা দেখেছি কোভিড-১৯ সংক্রমণের রোগীদের শ্বাসকষ্টের তীব্র বৃদ্ধি। এবং এ ধরনের রোগীদের ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয়। এই মেশিনটি অতি জটিল এবং একে চালানোর জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। এ ছাডা় রোগীর শ্বাসনালীতে একটি টিউব সংযোগ করতে হয়, যার জন্য অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বা ইমারজেন্সি চিকিৎসক বা ইনটেনসিভিস্ট প্রয়োজন। ইন্ট্রাভেনাস দেওয়ার সময়ে রোগীকে ঘুম পাড়ানো প্রয়োজন, সামান্য ওভারডোজ হয়ে গেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এবং শেষ পর্যন্ত যাঁরা কোভিড-১৯-এর হাত থেকে বেঁচে হিয়েছেন তাঁদের প্লাজনা গুরুতর রোগীদের দেওয়া হয়ে থাকে। আইসিইউ বেডের এইগুলিই বৈশিষ্ট্য, এ ছাড়া অতিরিক্ত কিছু এতে নেই।

গোষ্ঠীগত দেখভাল- হাসপাতালের উপর থেকে চাপ কমানোর সেরা উপায় হল, যাদের হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, তাঁদের যতক্ষণ নিরাপদে সম্ভব, হাসপাতাল থেকে দূরে রাখা। বাড়িতে নিরাপদে রাখার অর্থ হল উপসর্গযুক্ত রোগীর শ্বাসের হিসেব রাখা (প্রতি মিনিটে কতবার নিঃশ্বাস নিচ্ছেন- সাধারণ মানুষ গড়ে ১২ বার নিয়ে থাকেন), এবং পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে অক্সিজনে স্যাচুরেশনে হিসেব রাখা। অনলাইনে যেসব শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলির সাহায্যে প্রতিবেশী কাউকে বা কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের এ বিষয়টি শিখিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

যদি অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যায় বা শ্বাসের হার বাড়তে থাকে, তাহলে শুরুতেই অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে যাবার সুযোগ নেই, এং তাঁদের বাড়িতে বা নিকটবর্তী কোভিড কেয়ার সেন্টারে অক্সিজেন দেওয়া যেতে পারে। মাত্র কয়েকজনকেই হাসপাতালে যেতে হবে।

এ ব্যাপারে কয়েকটি ব্যতিক্রম থাকলেও সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানে এটাই প্রবহমানতা। (আমরা ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য কোনও ক্লিনিকাল পরিসংখ্যান পাইনি।)

এই কৌশল নতুন কিছু নয়। এপ্রিল মাসে নিউ ইয়র্কে যখন মহামারী তুঙ্গে ছিল, তখন রোগীদের পালস অক্সিমিটার, এমনকী অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ভারতের বহু রাজ্য তখন অপ্রমাণিত বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছিল।

যেসব গোষ্ঠী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মশলার গুঁড়ো, আর্সেনিকাম অ্যালবাম বা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন না দিয়ে এখন বরং পালস অক্সিমিটার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে একটি স্টেরয়েড এবং অ্যান্টিভাইরাল রেমডিসিভির একাধিক ব্যাপক সংক্রমিত হসপিটাল কেসে কার্যকর হয়েছে। ভারতে মাঝারি সংক্রমিতদের জন্য ফ্লাপিরাভির অনুমোদিত হয়েছে, তবে সে সম্পর্কিত পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি। তবে মনে রাখতে হবে ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ একদিনের মধ্যে সংক্রমণ কমাতে পারে। তাতে রোগ সারে না।

কোভিড ১৯ ভারতের সব এলাকা ছারখার করে দেবে। অতি-স্থানীয় ভিত্তিতে বিজ্ঞানভিত্তিক মোকাবিলাই সেরা উপায়। ধারাভি ও কেরালা সম্পূর্ণ আলাদা- তারা দেখাচ্ছে প্রেক্ষিত নির্ভর কৌশল কীভাবে কার্যকর হয়। কোভিডাক্রান্তদের অধিকাংশই সুস্থ হয়ে যাবেন। যাঁদের কিছু উপসর্গ রয়েছে, তাঁদের দেখভাল করতে হবে, পাল্স অক্সিমিটার বা তা ফুরিয়ে গেলে শ্বাসের হারের  হিসেব রাখার মাধ্যমে। শ্বাসের সমস্যা হলে অক্সিজেন দিতে হবে।

সামান্য কিছু জন অতি অসুস্থ হবেন, তাঁদের ক্রিটিকাল কেয়ার প্রয়োজন। কঠোর সত্যি হল, এঁদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় সে সুযোগ পাবেন না। অতিমারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে কয়েক দশকের অবহেলা ঠিক করে ফেলা যায় না।

COVID-19