গত সপ্তাহে মার্কিন সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রশন (FDA) আপৎকালীন হিসেবে কোভিড-১৯ রোগীদের উপর রেমডেসিভির ওষুধ প্রয়োগ করার অনুমতি দিয়েছে। মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিট্যুট অফ অ্যালার্জিস অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (NIAID)-এর ডিরেক্টর ডক্টর অ্যান্টনি ফাউসি এই ওষুধের পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন। এবং গত সপ্তাহেই ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই ওষুধের উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
রেমডিসিভির কী?
২০১৪ সালে ইবোলার চিকিৎসার জন্য মার্কিন বায়োটেকনোলজিক্যাল সংস্থা গাইলিড সায়েন্সেস এই ওষুধ প্রস্তুত করে। করোনাভাউরাস পরিবার বাহিত দুই রোগ মার্স ও সার্সের জন্য এ ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে তাতে খুব সাড়া মেলেনি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা হচ্ছে এই ওষুধের অ্যান্টিভাইরাল উপাদান সার্স কোভ ২-এর বিরুদ্ধে কাজ করে কিনা।
কোভিড-১৯ : সরকারের আর্থিক প্যাকেজ যত দ্রুত ঘোষণা করা হয় ততই মঙ্গল
রেমডেসিভিরের উপর ভরসা করার কারণ কী?
সার্স কোভ ২ মানবশরীরের কোষে নিজেকে বৃদ্ধি করে নেয় RdRp নামের এক এনজাইমের সহায়তায়। রেমডেসিভির যদি ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয় তাহলে তা ওই এনজাইমকে দমন করে এবং করোনাভাইরাস বৃদ্ধি আটকে দেয়।১৩ এপ্রিল জার্নাল অফ বায়োলজিকাল কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয় এই ওষুধ ভাইরাস আটকাতে সক্ষম এবং মানবকোষে তার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে।
গাইলিড সায়েন্সেসের চেয়ারম্যান তথা সিইও ড্যানিয়েল ও ডে বলেছেন, “জানুয়ারি থেকে আমাদের টিম দিনরাত খেটে চলেছে একথা বোঝার জন্য যে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভির কাজ করবে কিনা। এর মধ্যে গবেষক অনুসন্ধানী দল রয়েছে, সরকারের নানাবিধ ক্লিনিকাল ট্রায়াল রয়েছে। রেমডিসিভির অতিমারী পরিস্থিতি সহজতর করতে পারে এ খবর আমাদের মত আশাবাদীদের পক্ষে দারুণ।”
শিথিলতর লকডাউন ৩.০ কি বাড়াতে পারে বিপদ, কী বলছে সংখ্যার হিসেব?
এ নিয়ে গবেষণা কারা করছিল?
হুয়ের নজরদারিতে একটা অনুসন্ধান চলছিল। এ ছাড়া ছিল গাইলিডের নিজস্ব স্টাডি, মার্কিন সংস্থা NIAID-এর ট্রায়াল, ফরাসি সংস্থা ইনসার্মরে ডিসকভারি স্টাডি এবং চিনের দুটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল।
গাইলিডের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে তারা মার্কিন সংস্থা FDA, CDC, স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা দফতর, NIAID এবং ডিপার্ট অফ ডিফেন্স-CBRN মেডিক্যাল, চিন সিডিসি এবং NMPA, বিশ্ব স্বাস্থ্ সংস্থা ও ইউরোপ এবং এশিয়ার গবেষক ও ক্লিনিশিয়ানদের সঙ্গে নিয়ে রেমডেসিভিরের অ্যান্টিভাইরাল উপাদান পরীক্ষা করেছে।
রেমডিসিভিরের ৫ দিনের কোর্স ১০ দিনের মত কোর্সের ফলাফল দেয় কিনা সেটা দেখাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে তেমন ইঙ্গিতই মিলেছে। এই ট্রায়ালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৩৯৭ জনের উপর ট্রায়াল চালানো হয়েছে।
গাইলিডের এক মুখপাত্র বলেছেন, চিকিৎসায় সময় কম লাগলে হাসপাতাল থেকে দ্রুত রোগীদের ছেড়ে দেওয়া যাবে এবং আরও বেশি মানুষকে একই পরিমাণ ওষুধে চিকিৎসা করা যাবে।
লকডাউনের আঁধারে বাংলার বই প্রকাশনার দুনিয়া
কী উপকার দেখা গেল?
প্রাথমিক ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে যাঁদের রেমডেসিভির দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মৃত্যুহার ৮ শতাংশ, যাঁদের দেওয়া হয়নি তাঁদের মধ্যে ১১.৬ শতাংশ।
সুস্থ হওয়ার সময়কাল ১৫ দিন থেকে কমে ১১ দিন হয়েছে। ট্রায়ালের সম্পূর্ণ ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি।
NIAID ডিরেক্টর ফাউসি হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেছেন রেমডেসিভির নিয়ে যে পরিসংখ্যান মিলছে, তা দেখাচ্ছে স্পষ্ট, তাৎপর্যবাহী এবং আরোগ্যের সময় কমাবার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রভাবসৃষ্টিকারী। যগিও ৩১ শতাংশ উন্নতি ১০০ শতাংশের মত নয়, তা হলেও এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এ ওষুধ ভাইরাস আটকাতে পারে।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসনে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ১০ দিনের রেমডেসিভির কোর্স করার পর অক্সিজেন মাত্রার উন্নতি ঘটেছে।
হারভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের কার্ডিওলজির অধ্যাপক ডক্টর জগমিত সিং কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং নিউমোনিয়ার জন্য তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। আমেরিকায় রেমডেসিভির ট্রায়ালের তিনিও একজন অংশগ্রহণকারী, যদিও তিনি জানেন না তাঁকে কোনদিকে রাখা হয়েছিল এবং তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল তিনা। তিনি বলেন, এই ওষুধে নিশ্চিতভাবেই হাসপাতালবাসের দিন ৩০ শতাংশ কমেছে এবং মৃত্যুহার গ্রাসের দিতে কিছুটা প্রমাণও মিলছে, তবে পরিসংখ্যানের এখনও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গাইলিডের গবেষণায় বৈজ্ঞানিক খামতি আছে বলে মনে করেন তিনি।
সবাই আশাবাদী নয় কেন?
২৯ এপ্রিল ল্যান্সেটের গবেষণাপত্রে চিনের ১০টি হাসপাতালের ২৩৭ জন রোগীর কথা লেখা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এই গবেষণা মারাত্মক কোভিডআক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে করা হয়েছিল এবং উল্লেখযোগ্য যে উপকার পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে রেমডেসিভির নেই।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে ১৮ জনের মধ্যে রেমডেসিভিরের কুপ্রভাব দেখা দেওয়ায় তাঁদের ওই ওষুধ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। আরও বলা হয়েছে রেমডেসিভির দিয়ে যাঁদের চিকিৎসা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৬৬ শতাংশের শরীরে কুপ্রভাব দেখা দিয়েছে।
ভারতে কী পরিমাণ রেমডেসিভির প্রয়োগ করা হচ্ছে?
মুম্বইয়ের লীলাবতী হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার ডাক্তার রবিশংকর, যাঁদের কাছে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ২৫ জন কোভিড রোগী ছিলেন, যে রোগীদের অধিকাংশকেই ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাখতে হয়েছিল, সেখানে চিকিৎসকরা নানারকম ওষুধ ব্যবহার করলেও রেমডেসিভির প্রয়োগ করেননি। তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ রোগীদের উপর রেমডেসিভিরের কুপ্রভাবের রিপোর্ট সারা পৃথিবী থেকে আসছে। যদি রোগীদের অবস্থা সংকটজনক হয়, তাঁদের নিয়ে আমরা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি না।”
পালমোনোলজিস্ট ডক্টর জলিল পার্কার বলেছেন, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের থেকে যথেষ্ট পরিমাণ পরিসংখ্যান আগে আসা দরকার। “কিন্তু এখন আমাদের কাছে বেশি উপায় নেই, কোবিড-১৯ রোগীদের উপর নতুন ওষুধ প্রয়োগ করতেই হবে। ট্রায়ালের রেজাল্ট আসার আগে কোনও ওষুধ ব্যবহার করবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককেই নিতে হবে।”
ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে কীরকম?
জানুয়ারি মাস থেকে উৎপাদনে বিনিয়োগ বেড়েছে এবং সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি হয়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত ৫০০০ রোগীর ১০ দিনের কোর্সের মত ওষুধ মজুত ছিল। মার্চের শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার রোগীর মত ওষুধ। মে-র শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১.৪ লক্ষ রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ। কমপ্যাশনেট ইউজ প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ক্ষেত্রে গর্ভবতী মহিলা ও শিশু ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওষুধ সরবরাহ আর করবে না গাইলিড। ভারত সে প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন সংস্থার মুখপাত্র।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন