কোভিড ১৯ অতিমারীর জন্য বৃহত্তর স্বার্থে যেসব দিন আনা গিন খাওয়া মানুষ বাধ্যত বাড়ি থাকছেন, তাঁদের উপর থেকে চাপ দূর করতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্রকল্পে এই প্যারেজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক কী কী?
রেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা খাদ্যশস্যের পরিমাণ বাড়ানো নিঃসন্দেহে একটা বড় পদক্ষেপ। সাধারণ একটি গরিব পরিবারে পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক সদস্যের মাসে ৫০ থেকে ৫৫ কিলো খাদ্যশস্য ও ৪ থেকে ৫ কিলোগ্রাম ডাল প্রয়োজন হয়। বর্তমানে রেশনে প্রতিমাসে মাথা পিছু ২ টাকা কেজি দরে গম ও ৩ টাকা কেজি দরে চাল মোট ৫ কেজি করে দেওয়া হয়ে থাকে। তার অর্থ পাঁচজনের পরিবার চাল গম মিলিয়ে ২৫ কেজি খাদ্যশস্য পেয়ে থাকে।
এই প্যাকেজের আওতায় অতিরিক্ত মাথা পিছু ৫ কিলো করে চাল বা গম প্রতিমাসে বিনামূল্যে দেওয়া হবে। আগামী তিন মাস ধরে এই বরাদ্দ বিনামূল্যে পাবার ফলে পরিবারের সারা মাসের চাল গমের চাহিদা মিটবে।
মোটামুটা ভারতের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ বা ৮০ কোটি মানুষ জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় এই সুবিধা পাবেন। এই গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা, যাঁরা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের খোলা বাজার থেকে চাল-গম কিনতে হবে না এ ছাড়া প্রতি মাসে পরিবার পিছু ১ কেজি করে ডাল বিনামূল্যে দেবার কথা বলা হয়েছে এই প্যাকেজে। তার ফলে তাঁদের চাহিদার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মিটবে।
আরও পড়ুন, কাকে বলে কনট্যাক্ট ট্রেসিং, কীভাবে এর মাধ্যমে রোগের প্রকোপ আটকানো সম্ভব?
এসবের দাম কত পড়বে, বাল্তবত বিষয়টা কতটা কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হবে?
যেসব রাজ্যে রেশন ব্যবস্থা ভাল ভাবে চালু রয়েছে, এর সুবিধা পাবে তারা। যেমন কেরালা, তামিলনাড়ু, ছত্তিসগড়, ওডিশা। কিন্তু উত্তর প্রদেশ বা বিহারে রেশন ব্যবস্থা তেমন কার্যকর নয়। ২০১৯-২০ সালে ফুড কর্পোরেসন অফ ইন্ডিয়ার প্রতি কেজি গম সংগ্রহ ও বিতরণের খরচ পড়েছিল ২৬ টাকা ৮০ পয়সা এবং প্রতি কেজি চালের ক্ষেত্রে ওই খরচ দেখা গিয়েছিল ৩৭ টাকা ৪৮ পয়সা। গড়ে ৩০ টাকা হিসেবে ধরলে, ৮০ কোটি মানুষকে আগামী ৩ মাস ধরে ১৫ কেজি করে খাদ্যশস্য বিতরণের জন্য অতিরিক্ত খরচ পড়তে চলেছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু এর অন্য দিকও রয়েছে। আর্থিক খরচের মধ্যে এফসিআইয়ের গুদামজাত করার ও তার রক্ষণাবেক্ষণের খৎচ ধরা হয় না। এই খরচ, মূলত সুদ ও গুদামজাত রাখার খরচ ২০১৯-২০ সালে ছিল প্রতি কেজিতে ৫ টাকা ৬০ পয়সা। ১২ মিলিয়ন টন শস্য- অর্থাৎ, ৮০ কোটি মানুষের জন্য ১৫ কেজি করে- এর গুদামজাত রাখার খরচ ৬৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অতিরিক্ত পণ্য দেবার নেট খরচ ৩০ হাজার কোটি টাকার নিচেই থাকবে।
২০ কোটি পরিবারকে বিনামূল্যে ৩ কেজি করে ডাল দেবার খরচ অতিরিক্ত ৪০০০ কোটি টাকা ধরলে সেখানেও পরিবহণ খরচ ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা- সেক্ষেত্রেও মোট খরচ ৩৫ হাজার কোটি ছাড়াবে না।
এফসিআই ও ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল কোঅপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার কাছে এখন যথাক্রমে ৭৭.৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য (প্রয়োজনের চেয়ে ৩.৫ গুণ বেশি) ও ২.২ মিলিয়ন টন ডাল রয়েছে। এর ফলে অতিরিক্ত মজুত কার্যকর উপায়ে বিতরণ করা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন, “ঐক্যবদ্ধ অনুশাসনের মাধ্যমেই করোনাপ্রতিরোধী লড়াই চালাতে হবে”
এ ছাড়া আর কী ছাড়ের কথা বলা হয়েছে?
সীতারমণ জানিয়েছেন, আগামী ৩ মাস গরিব পরিবারগুলিকে বিমানূল্য গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া হবে। যদি ধরে নেওয়া হয় ভরতুকিহীন গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ৮০০ টাকা করে গড়ে এবং এই পরিবারগুলির আগামী তিন মাসে ৩টি করে সিলিন্ডার লাগবে, তাহলে খরচ হচ্ছে ১৯,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ খরচটুকু জরুরি, সরকার অন্তত আগামী তিন মাস গরিব মানুষগুলোর জন্য ডাল-ভাত-জ্বালানির বন্দোবস্ত করুক।
মনরেগা প্রকল্পের দৈনিক মজুরি ২০ টাকা বাড়িয়ে, ১৮২ টাকা থেকে ২০২ টাকা করে দেবার ফলে উপকার হবে কি?
না। লকডাউনের মধ্যে মনরেগার কাজ হবার সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে মনরেগা পরিবারগুলিতে সব মিলিয়ে ১৩.৬৫ কোটি জব কার্ড দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৮.২২ কোটি সক্রিয়। এঁদের বেকার ভাতা দেওয়া উচিত।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন ২০ টাকা করে মজুরি বৃদ্ধির ফলে প্রতি পরিবারে ২০০০ টাকা করে অতিরিক্ত রোজগার হবে। এ একেবারেই তাত্ত্বিক হিসেব, ধরে নেওয়া হয়েছে সমস্ত কার্ডধারীরা এই প্রকল্পে ১০০ দিন করে কাজ পাবেন। দৈনিক মজুরি কর্মীরা ঘরে থাকবেন বলে যখন ধরে নেওয়া হচ্ছে, তখন মনরোগা কর্মীদের বেকার ভাতা দেওয়াই সংগত। তবে এ দায় শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারগুলির উপর বর্তায়। তারা বাজেটে এই প্রয়োজনীয় সংস্থান করবে বলে মনে হয় না।
হ্যাঁ, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনাভুক্ত মহিলাদের ২০.৪ কোটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে আগামী তিন মাস দেবার কথা বলা হয়েছে।
বাধ্যতামূলক ভাবে যাঁরা কাজ করতে পারছেন না তাঁদের জন্য এটা কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি যোজনাভুক্ত ৮.৭ কোটি কৃষককে ২০০০ টাকা করে দেওয়াও একই রকম। কৃষকদের এই প্রকল্পে বছরে ৬০০০ টাকা করে সাহায্য পাবার কথা, যার ২০২০-২১ সালের প্রথম কিস্তির ২০০০ টাকা এমনিতেই আসার কথা ছিল এপ্রিলে। এই করোনা পরিস্থিতিতে যখন বাজার ধসে যাবার ফলে তাঁরা শস্যের প্রয়োজনীয় দাম পাচ্ছেন না, এবং ফসল কাটার শ্রমিক পাচ্ছেন না, সে সময়ে এই অতিরিক্ত অর্থটুকু তাঁদের কাছে কিছুই নয়।
তাহলে প্যাকেজটা বাস্তবত কী দিচ্ছে?
গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের কাছে মূল সমস্যা নগদ অর্থের। বড় ব্যবসায়ী বা বেতনভোগী মধ্যবিত্তের মত এই মানুষগুলির কোনও ব্যালান্স শিট থাকে না, জমা থাকে না, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স থাকে না। একদিন কাজ না থাকার অর্থ এঁদের কাছে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খরচ না করতে পারা এবং আরও বেশি করে দেনার ভারে ঝুঁকে পড়া। বিমানূল্যের খাদ্যশস্যে তাঁদের সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের সংকট দূর করতে পারবে না, যে সংকট নগদের। এঁদের খাবার ছাড়া অন্য জিনিস কেনবার জন্য নগদ টাকা দরকার, যা সম্ভবত কদিন আগেও তাঁদের হাতে ছিল।