এ মাসের গোড়ায়, সরকার কোভিড ১৯ মোকাবিলার জন্য সমস্ত এমপি ল্যাডের অর্থ বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রের ঘোষণার পরেই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের এমপি ল্যাড প্রকল্প এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন, যার অর্থ রাজ্য এখন কোভিড সংক্রান্ত প্রকল্পে ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে পারবে।
এমপি ল্যাড প্রকল্প কী?
এমপি ল্যাড (মেম্বারস অফ পার্লামেন্ট লোকাল এরিয়া ডেভেলপমেন্ট) হল একটি প্রকল্প, যার আওতায় সাংসদরা নিজেদের লোকসভা ক্ষেত্রে বছরে পাঁচ কোটি টাকা খরত করতে পারেন। লোকসভা এবং রাজ্যসভার নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্যদের এই অধিকার রয়েছে।
রাজ্যগুলিরও তাদের বিধায়কের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের সুবিধা দিয়ে থাকে, তার পরিমাণ বিভিন্ন। দিল্লির এমএলএ ল্যাডের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাঁরা নিজ ক্ষেত্রে বছরে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেন। পাঞ্জাব ও কেরালায় এই পরিমাণ বিধায়ক পিছু পাঁচ কোটি টাকা, আসাম, ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে বিধায়ক পিছু ২ কোটি টাকা এবং উত্তরপ্রদেশে এই পরিমাণ বর্তমানে ২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করা হয়েছে।
কোভিড ১৯ আর লকডাউনে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বনাশ
এমপিল্যাডের টাকা বন্ধ করে অতিমারী মোকাবিলায় কেন্দ্রের কত সুবিধা হবে?
এর ফলে সরকারের ৭৮০০ কোটি টাকা বাঁচবে। তুলনার জন্য উল্লেখ করা চলে, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় যে ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকা দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তার পরিমাণ এই এমপিল্যাডের ৪.৫ শতাংশ মাত্র।
বিরোধী বিধায়করা এর প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। কংগ্রেস সংসদীয় দলেন নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তুমুল অবিচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা বলেছেন, এর ফলে এমপিল্যাডের টাকা কেন্দ্রীভূত হবে এবং তা খরচ করতে দেরি হবে।
কীভাবে এই প্রকল্প চলে?
বিধায়ক বা সাংসদরা এই প্রকল্পের কোনও অর্থ হাতে পান না। সরকার সরাসরি এই অর্থ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। সাংসদ বা বিধয়করা তাঁদের এলাকায় নির্দিষ্ট গাইডলাইনের ভিত্তিতে কোন খাতে অর্থ ব্যয় হবে তা স্থির করতে পারেন মাত্র।
এমপিল্যাডের অর্থব্যয় সম্পর্ক নির্দেশিকায় বাড়ি, স্কুল ইত্যাদি স্থিতিশীল সম্পদ সৃষ্টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। অস্থায়ী কোনও সম্পদের পিছনে এই অর্থব্যয় কেবলমাত্র সীমিত পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। যেমন গত মাসে সরকার এমপিল্যাডের অর্থে পিপিই বা করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট কেনার অনুমতি দিয়েছে।
কোভিড মৃত্যুতে আমেদাবাদ দু নম্বরে, মুম্বই শীর্ষে
বিধায়কল্যাডের অর্থ খরচের ক্ষেত্রে নির্দেশিকা একেক রাজ্যে একেকরকম। যেমন দিল্লির বিধায়কদের ডেঙ্গি মশা তাড়াবার যন্ত্র বা সিসিটিভি ক্যামেরার পিছনে এই অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হয়ে থাকে। আইনপ্রণয়ণকারীরা উন্নয়নকাজের তালিকা প্রস্তুত করেন, সেগুলি সরকারের অর্থ, প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক আইন মেনে নিষ্পন্ন করে জেলা কর্তৃপক্ষ।
কবে থেকে এই প্রকল্পের সূচনা?
প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও ১৯৯৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর লোকসভায় এই প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন। বিভিন্ন দলের সাংসদদের অনুরোধে প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন সিপিআইএম সাংসদ নির্মলকান্তি চট্টোপাধ্যায় ও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
নরসিমা রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকার যখন টানাপোড়েনের মধ্যে, সেই সময়েই এই প্রকল্পের সূচনা। সে মাসের গোড়ায় নির্বাচন কমিশনকে একাধিক সদস্য সম্বলিত করে নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষনের ডানা ছাঁটার অভিযোগে সংসদ উত্তাল হয়। কয়েক মাস আগে, বিতর্কিত আস্থা ভোটে জিতে কোনওক্রমে টিকে যায় সরকার।
সে বছর মে মাসে, লোকসভা সাক্ষী থেকেছে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার হাইকোর্টের বিচারপতি ভি রামস্বামীর বিরুদ্ধে আনা ইমপিচমেন্টের। কেউ কেউ মনে করেন, সংখ্যালঘু সরকার সাংসদদের সঙ্গে সমঝোতায় এই প্রকল্প শুরু করে। পরের বছরগুলিতে বিভিন্ন রাজ্য এই প্রকল্প শুরু করে।
আরও নোট ছাপা হবে, না হবে না
কতদিন এই প্রকল্প চলবে?
কেন্দ্রীয় প্রকল্প ২৭ বছর একটানা চলেছে। অর্থদফতর এর বাজেট তৈরি করে এবং সরকার সম্মতি দিলে তা চলতে থাকে।২০১৮ সালে অর্থ বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি এই প্রকল্প চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মেয়াদ পর্যন্ত, অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ মার্চ অবধি এর অনুমোদন দিয়েছে।
সাম্প্রতিক অতীতে, ল্যাড বন্ধ রাখার একটিই উদাহরণ পয়েছে। ২০১০ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এই বরাদ্দ বন্ধ করে দেন, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ফের তা চালু করেন।
এমপিল্যাডের সুফল কী?
২০১৮ সালে যখন প্রকল্প চালু রাখার অনুমোদন পাওয়া যায়, তখন সরকার বলেছিল, এমপিল্যাড প্রকল্পের আওতায় স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় পানীয় জল, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, রাস্তা প্রভৃতি স্থায়ী সম্পদ নির্মাণের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ সুবিধা পেয়েছেন।
২০১৭ সাল পর্যন্ত, এমপিল্যাডে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় ২৯ লক্ষ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ প্রকল্প গ্রামীণ এলাকায় ও বাকিটা শহর ও আধাশহরাঞ্চলে।
মাঝেমাঝেই এ প্রকল্প সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন?
মূলত দুটি কারণে সমালোচনা উঠে আসে। প্রথমত, আমলাতান্ত্রিক কাজে আইনপ্রণেতাদের অংশগ্রহণ সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন ডিএমকের প্রাক্তন সাংসদ ও পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এরা সেজিয়ান।
তাঁর বক্তব্য ছিল এই প্রকল্পের ফলে সাংসদের উপর যে কাজের বোঝা চাপবে, তার জেরে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতারক্ষা এবং অন্যান্য আইনসভার কাজকর্মে প্রয়োজনীয় মনোযোগে ঘাটতি পড়বে। সংবিধানের কাদের পর্যালোচনার জন্য জাতীয় কমিশন (২০০০) এবং বীরাপ্পা মইলি নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০৭) এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় এই প্রকল্প সাংবিধানিক।
দ্বিতীয় সমালোচনার জায়গা এ কাজের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতির। ক্যাগের তরফ থেকে বহুবার এর প্রয়োগে ঘাটতির বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে।
(লেখক পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চের আউটরিচ হেড)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন