গত সপ্তাহে ল্যান্সেটের এক গবেষণা কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এদিকে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পক্ষে সওয়াল করেছেন, জানিয়েছেন তিনি নিজেও এই ওষুধ ব্যবহার করছেন।
এই ওষুধ এখন সারা বিশ্বে বিতর্কের কেন্দ্রে। ভারতে এ ওষুধ চিকিৎসার জন্য তো বটেই, এমনকী এক্সপোজার পরবর্তী প্রতিষেধক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর ব্যবহার নিয়ে গাইডলাইন পরিবর্ধিত করেছে এবং বর্তমানে ৫৫টি দেশে এ ওষুধ রফতানিও করছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর কার্যকারিতা নিয়ে সতর্ক।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রারাইটিস এবং লুপাসের মত অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক ও চিকিৎসার জন্যও এ ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার নিয়ে মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলেছে, যেখানে ক্লোরোকুইন কার্যকরী, সেখানেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া উচিত। পৃ্থিবীতে মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের মত কিছু জায়গাতেই কেবলমাত্র হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এখনও কার্যকর।
গর্ভবতী মহিলা, মাতৃদুগ্ধ ও কোভিড সংক্রমণ
কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় যেসব দেশ বিধিনিষেধ সহ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন অনুমোদন করেছে, তার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা (হাসপাতালে আপৎকালীন ব্যবহার), ফ্রান্স (প্রেক্রিপশন থাকলে), ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া।
এ ওষুধ নিয়ে এত কথা কেন?
এর গোড়ার কারণ হল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট। তাতে তিনি লিখেছিলেন "হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন, একসঙ্গে ব্যবহার করলে পৃথিবীর মেডিসিনের ইতিহাসে বৃহত্তম পরিবর্তন ঘটে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এফডিএ পাহাড় সরিয়েছে- আপনাদের ধন্যবাদ। আশা করি এই দুটিকে একসঙ্গে দ্রুত ব্যবহার করা হবে। মানুষ মারা যাচ্ছে, দ্রুত ব্যবস্থা নিন, ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করুন।"
এর কিছু পরেই ভারতের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রফতানি নীতি পরিবর্তন না করলে তার বদলা নেওয়ার হুমকি দেন। ভারত তারপরেই সে নীতির সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। কয়েকদিন আগে ট্রাম্প জানিয়েছেন, এক্সপোজার পরবর্তী প্রতিষেধক হিসেবে তিনি এই ওষুধ খান।
ট্রাম্পের এই মত মার্কিন গাইডলাইন ও বৈজ্ঞানিক অনুমানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
মার্কিন সংস্থা এফডিএ বলেছে, তারা যেসব কোভিড ১৯ রোগীদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছে, তাদের হৃদস্পন্দনের ছন্দের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।
তারা আরও জানিয়েছে যে আউটপেশেন্টদের প্রেসক্রিপশনসহ এই ওষুধের ব্যবহার প্রচুর বেড়েছে, তবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ প্রতিষেধক হিসেবে বা চিকিৎসার জন্য নিরাপদ বা কার্যকরী ফলদায়ক হিসেবে দেখা যায়নি। কোভিড ১৯ চিকিৎসায় এগুলির ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের উপায় না থাকলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এর আপৎকালীন ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোভিড-১৯ বদলে দিতে পারে কর্মসংস্কৃতি
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতার পক্ষে বা বিপক্ষে কী জানা গিয়েছে?
বিভিন্ন বিপরীতমুখী প্রমাণ মিলছে। সাম্প্রতিকতম ল্যানসেটে প্রকাশিত আর্টিকেলে যা বলা হচ্ছে তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। "আমরা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন হাসপাতালের কোভিড-১৯ রেগীদের উপর একক ভাবে বা ম্যাক্রোলাইডের সঙ্গে ব্যবহার করে দেখেছি। এ ধরনের ওষুধের ব্যবহারে হাসপাতালে বাঁচার সম্ভাবনা কমেছে এবং ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিথমার সংখ্যা বেড়েছে।" মার্কোলাইড একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক যার মধ্যে অ্যাজিথ্রোমাইসিন রয়েছে।
এদিকে ১৭ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টসে একটি ছোট গবেষণায় বলা হয়েছে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহারে রোগীদের মধ্যে ভাইরাল লোড কমেছে। তবে যেহেতু তাঁরা মাত্র ২০ জন রোগীর উপর এই নিরীক্ষা চালিয়েছেন, সে কারণে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিট্যুট অফ হেলথের সহায়তায় এক গবেষণায় বলা হয়েছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা কমানোর ব্যাপারে তেমন কোনও কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি।
তবে যেসব দেশে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সে সব দেশে মৃত্যুহার কম। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পরিচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে হৃৎস্পন্দনের ছন্দ বদল, পেটের গণ্ডগোল, মাথাব্যথা, ঝিমুনি, বিভ্রম ইত্যাদি।
হু কী বলছে?
হু জানিয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোনও কার্যকর ফল না দিলেও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালভাবেই দেখা যাচ্ছে। হুয়ের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর ডক্টর মাইকেল রায়ান বুধবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, "প্রতিটি সার্বভৌম দেশের যে কোনও ওষুধ নিজের নাগরিকদের জন্য ব্যবহারের অধিকার রয়েছে... হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ওষুধ। তবে এসব ওষুদের কোভিড ১৯ চিকিৎসায় বা প্রতিষেধক হিসেবে কোনও ইতিবাচক ফলাফলের খবর নেই, বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিার কথা অনকে বলেছেন। সব দেশের কর্তৃপক্ষকেই এই ব্যাপারে সমস্ত দিক খতিয়ে দেখতে হবে।"
ভারতের অবস্থান কী?
শুক্রবার ভারতে এই ওষুধের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দেশিকার নতুন করে পরিশোধন করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, শুধু স্বাস্থ্যকর্মীরাই নন, সামনের সারিতে যাঁরা কাজ করছেন, সেই আধাসামরিক বা পুলিশবাহিনীর মধ্যেও এ ওষুধ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
তবে যাঁদের রেটিনোপ্যাথি, হাইপারসেনসিটিভিটি, হৃদযন্ত্রের সমস্যা বা গ্লুকোজ ৬ ফসফেটের ঘাটতি রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে এ ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। গর্ভবতী বা দুগ্ধবতী মা এবং ১৫ বছরের নিচের শিসুদের ক্ষেত্রেও এ ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। ইসিজি করার পরেই এ ওষুধ দেওয়া যাবে।
১৩২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে এই ওষুধ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করায় যে সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হদিশ মিলেছে, তা হল বমিভাব (৮,৯ শতাংশ), পেট ব্যথা (৭.৩ শতাংশ), বমি (১.৫ শতাংশ), হাইপোগ্লাইসিমিয়া (১.৭ শতাংশ) ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা (১.৯ শতাংশ)। অ্যাডভাইজরিতে বলা হয়েছে, এই ওষুধ খাওয়ার জন্য যেন সুরক্ষার ব্যাপারে ভুল নিশ্চয়তা না তৈরি হয়।
কোভিড-১৯ এ গুরুতর আক্রান্তদের অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন একসঙ্গে দেওয়ার পরামর্শ জারি রয়েছে। তবে গত সপ্তাহে আইসিএমআর-এর এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের ডিরেক্টর আর আর গঙ্গাখেড়েকর বলেছন তারা এর প্রমাণাদি খুঁটিয়ে দেখছেন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন