সরকার স্থির করেছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের রফতানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে। এই ওষুধ কোভিড ১৯-এর চিকিৎসার জন্য ও প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করে তাঁর অনুরোধ মত ওষুধ ভারত না পাঠালে তার বদলা নেওয়া হবে বলে জানান। পরে ভারত জানায়, তারা যেখানে যেখানে প্রয়োজন ওষুধ পাঠাবে, যেসব প্রতিবেশীরা ভারতের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে আছে, তাদেরও।
গ্রীষ্মকালে করোনাভাইরাস মরে যেতে পারে, তবে সাবধানের মার নেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কী, কেন ব্যবহৃত হয়?
এটি একটি ম্যালেরিয়াপ্রতিরোধী ওষুধ, যা ক্লোরোকুইনের চেয়ে কম টক্সিক এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। রিউ ম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং লুপাসের মত রোগে এ ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ভারতে এ ওষুধ বানায় কারা?
২০২০-র ফেব্রুয়ারির আগের ১২ মাসে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের বাজারের আকার ছিল ১৫২.৮০ কোটি টাকা মাত্র। তবে বেশ কিছু দেশে এ ওষুধের উৎস ভারতই।
মুম্বইয়ের ইপকা ল্যাবরেটরিজ এ বাজারের ৮২ শতাংশ দখল করে রেখেছে, এদের এই ওষুধের ব্র্যান্ড নেম HCQS ও HYQ। ইপকার উৎপাদিত ওষুধের ৮০ শতাংশ রফতানি করা হয়। আমেদাবাদের ক্যাডিলা হেলথকেয়ার )জাইডাস ক্যাডিলা Zy Q ব্র্যান্ড নেম দিয়ে এই ওষুধ তৈরি করে, তাদের মার্কেট শেয়ার ৮ শতাংশ। এছাড়া ওয়ালেস ফার্মাসিউটিক্যালস (ব্র্যান্ড নেম OXCQ), টরেন্ট (HQTOR), এবং ওভারসিজ হেলথকেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড (CARTIQUIN)-এর সামান্য শেয়ার রয়েছে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেলে কোভিড ১৯ সারবে, কে বলল?
কোভিড ১৯ প্রকোপের সময়ে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কথা ফের সামনে উঠে এল কেন?
গতমাসে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টস (IJAA)-র গবেষণায় ফরাসি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০টি ঘটনায় চিকিৎসা হয়েছে, এবং ভাইরাল সংক্রমণে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে অ্যাজিথ্রোমাইসিন দেওযায় ভাইরাস নির্মূলীকরণে উল্লেখযোগ্য সুফল পাওয়া গিয়েছে।
গবেষণাটি অতি ছোট হওয়ায় তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি। ৩ এপ্রিল IJAA যাদের অধীন, সেই ইন্টারন্যাশনা সোসাইটি অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কেমোথেরাপি বলে, এই গবেষণা প্রত্যাশিত মান অনুসারী নয়। তবে ২১ মার্ট ট্রাম্প এই ওষুধকে গেম চেঞ্জার বলে অভিহিত করেন এবং তার পর থেকে এ ব্যাপারে বলে চলেছেন।
ফাভিপিরাভির- জাপানি ওষুধেই করোনামুক্তি?
গত মাসের শেষে আইসিএমআর একটি অ্যাডভাইজরি জারি করে যেসব স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিড ১৯ রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছেন কিন্তু উপসর্গবিহীন, তাঁদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাবার সুপারিশ করে। তবে সরকার জোর দিয়ে বলেছে এই ওষুধ কেবলমাত্র কোভিড ১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রেসক্রিপশনসহ বরাদ্দ করেছেন এবং বলেছে এর মাধ্যমে যেন নিরাপত্তার ভুল ধারণা না তৈরি হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
ভারত কবে থেকে এ ওষুধ রফতানি বন্ধ করেছে?
আমেরিকা এই ওষুধ চাইছে আপৎকালীন চিকিৎসার জন্য। ২১ মার্চ ইপকা স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায় আমেরিকার এফডিএ তাদের সংস্থার বিরুদ্ধে আমদানি অ্যালার্ট জারি করে নিয়মের ব্যতিক্রম করতে বলেছে।
ভারত ৪ এপ্রিল এই ওষুধের রফতানি নিষিদ্ধ করে। মঙ্গলবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি সত্যিই কার্যকর?
কোভিড ১৯ চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে দুটি বড়সড় ট্রায়াল চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ ট্রায়ালে, ভারতও যার অংশ, সারা পৃথিবীর ক্লিনিশিয়ানরা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মাধ্যমে চিকিৎসার নির্দিষ্ট একটি প্রোটোকল মেনে চলেছেন।
দ্বিতীয়ত ক্লোরোকুইন অ্যাকসিলারেটর ট্রায়াল চলছে যার উদ্যোগে রয়েছে ওয়েলকাম ট্রাস্ট ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
গবেষণায় যুক্ত ডক্টর শাহিদ জামিল জানিয়েছেন, দু জায়গাতেই ব্যাপক সংখ্যক রোগীদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। এ পরীক্ষার ফল এখনও মেলেনি।
স্বাস্থ্যকর্মীরা যাঁরা ব্যাপক পরিমাণ এক্সপোজারের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা যদি সীমিত পরিমাণে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা ক্লোরোকুইন খান তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু সকলে মিলে যদি এসব ওষুধ খেয়ে ভাবেন তাঁরা নিরাপদ তাহলে বিপদ। প্রথমত তাঁরা নিরাপদ নন, আর দ্বিতীয়ত এর ফলে ক্ষতিও হবে।
যাঁর অন্য কারণে এ ওষুধ খেয়েছেন তাঁদের ওপর এ রোগের প্রকোপের প্রভাব কেমন?
মার্চ মাসে ট্রাম্পের বিবৃতির পর শুধু আমেরিকায় আতঙ্ক ক্রয় (panic buying) শুরু হয়নি, ভারতের মজুত ভান্ডারেও চাপ পড়তে শুরু করে। ফোর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের চিকিৎসক নাভাল মেনডিরাত্তা বলেছেন, তিনি ইতিমধ্যেই রোগীদের কাছ থেকে ফোন পেতে শুরু করেছেন যে তাঁরা তাঁদের দীর্ঘদিনের ব্যবহার্য এ ওষুধ পাচ্ছেন না।
আইসিএমআরের নির্দেশাবলী অনুসরণ করে বেশ কিছু রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা হাইড্রক্সিক্লোরোকিউন মজুত করতে শুরু করেছেন। 1mg প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত ট্যান্ডনের মতে কিছু রোগী, যাঁরা এ ওষুধ আগে ব্যবহার করেননি, তাঁরাও অনলাইনে এ ওষুধ কেনার চেষ্টা করেছেন, তবে প্রেসক্রিপশন না থাকায় কিনতে পারেননি।
এটিকে শিডিউল ১ -এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার অর্থ প্রতিবার এ ওষুধ কিনতে নতুন প্রেসক্রিপশন লাগবে।
এক মাস হয়ে গেল ওষুধের দোকানে এ ওষুধ এখনও অমিল, যার ফল ভুগছেন এ ওষুধের নিয়মিত ব্যবহারকারীরা। কেউ কেউ জানিয়েছেন তাঁরা প্রেসক্রিপশন দেখিয়েও তাঁদের নিয়মিত ডোজটুকুও কিনতে পারছেন না।
ওষুধ কোম্পানিগুলি সমস্যা মেটাতে কী করছে?
ইপকার জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর অজিত কুমার জৈন জানিয়েছেন, সরকারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সংস্থার উৎপাদন বাড়াবার ক্ষমতা রয়েছে, এখন দেশীয় বাজারের প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হয়।
তবে অপব্যবহার আটকাতে সারা দেশের কিছু নির্বাচিত দোকানেই এই ওষুধ সরবরাহ করবে তারা। লকডাউন উঠে গেলে ধীরে ধীরে আরও বেশি পরিমাণে এই ওষুধ সুলভ হবে বলে আশা সংস্থার।
জাইডাস ক্যাডিলার মুখপাত্র জানিয়েছেন এখন তাঁরা ২০ থেকে ২০ টন এ ওষুধ বানাচ্ছেন। প্রয়োজনে তাঁরা মাসে ৪০-৫০ টন ওষুধও বানাতে পারবেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন