লকডাউনের জেরে অর্থনীতি যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং হাজার হাজার সংস্থা ও শ্রমিক যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কবলে পড়েছেন, তার জেরে বেশ কিছু রাজ্য শ্রম আইনে বদল এনেছে কয়েকটি রাজ্য। এর মধ্যে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের মত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ব্যাপক বদল এনেছে। তবে রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মত কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি, এবং বিজেডি শাসিত ওড়িশাতেও কিছু বদল আনা হয়েছে, যা তুলনায় অবশ্য কম। সর্বাধিক জনসংখ্যাসম্পন্ন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে কঠিন বদল এনে কার্যত রাজ্যের সমস্ত শ্রম আইন আগামী তিন বছরের জন্য বাতিল করে দিয়েছে।
মুখে বলা হচ্ছে এই বদলগুলি সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির অর্থনীতি চাঙ্গা করার উদ্দেশ্য আনা হয়েছে। আইনের কথা যদি বাদও দেওয়া হয়- শ্রম বিষয়টি যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত, এবং কেন্দ্র যদি কোনও রাজ্যের জন্য একাধিক আইন তৈরি করে, তাহলে রাজ্য সেগুলিকে অস্বীকার করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, শ্রম আইনের এই বদল কি অর্থনীতিবিদরা যে সংস্কারের কথা বলছিলেন, সেই উদ্দেশ্যপ্রসূত নাকি সমালোচকরা যেমন বলছেন, একটা খারাপ সময়ে শ্রম আইন বাতিল করে দেওয়ার একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ!
আরও পড়ুন, ভারতে রাসায়নিক দুর্ঘটনা বিষয়ে কী ধরনের সুরক্ষাকবচ রয়েছে?
ভারতের শ্রম আইন কী?
এ ব্যাপারে ২০০-র বেশি রাজ্য আইন ও প্রায় ৫০টি কেন্দ্রীয় আইন চালু রয়েছে। এবং এখনও পর্যন্ত দেশে শ্রম আইনের কোনও সংজ্ঞা নেই। সব মিলিয়ে সেগুলিকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ছবিতে এই ভাগগুলি উদাহরণ সহ বর্ণনা করা হয়েছে।
কারখানা আইনের মূল লক্ষ্য হল, যেমন কারখানা চত্বরে নিরাপত্তার বিষয় এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উদ্যোগ নেওয়া। অন্যদিকে দোকান ও বাণিজ্যিক সংস্থা আইনের সূচিমুখ হল কাজের সময়, পেমেন্ট, ওভারটাইম, সবেতন সাপ্তাহিক ছুটি, সবেতন অন্যান্যা ছুটি, বার্ষিক ছুটি, শিশু ও অল্পবয়সীদের নিয়োগ এবং মহিলা নিয়োগ।
ন্যূনতম মজুরি আইন অন্য যে কোনও শ্রম আইনের তুলনায় অনেক বেশি শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত শ্রম আইন হল লে অফ, ছাঁটাই, শিল্প সংস্থার ক্লোজার এবং ধর্মঘট ও লকআউট সম্পর্কিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭।
শ্রম আইন প্রায়শই সমালোচনার মুখে পড়ে কেন?
ভারতের শ্রম আইন প্রায়শই অস্থিতিস্থাপক বলে গণ্য করা হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে সমালোচনার বিষয় হল সংস্থাগুলিকে গুরুভার আইনি পদ্ধতি বহন করতে হয় (যাদের ১০০ জনের বেশি কর্মী রয়েছে, তারা নতুন কর্মী নিতে চায় না কারণ তাদের ছাঁটাই করতে হলে সরকারি অনুমতি প্রয়োজন। চার নম্বর ছবিতে দেখনো হয়েছে, এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই কর্মী নিয়োগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। একটা যুক্তি এখানে ওঠে যে এর ফলে একদিকে যেমন সংস্থার অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে থেমনই অন্যদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে সংস্থার কাঁচা চুক্তি হচ্ছে।
অন্যরা বলছেন, এমন বহু আইন রয়েছে যা অপ্রয়োজনীয় ভাবে জটিল এবং যথাযথভাবে লাগুও হয় না। এর ফলে দুর্নীতি ও অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তি তৈরি হয়।
ভারতে যদি সহজে অনুসরণযোগ্য শ্রম আইন থাকত, তাহলে সংস্থাগুলির বৃদ্ধি হতে পারত এবং বাজারের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ও চুক্তিও হতে পারত, যা আনুষ্ঠানিক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বর্তমানে ভারতের ৯০ শতাংশ শ্রমিক অসংগঠিক আর্থিক ক্ষেত্রের অংশ- এর ফলে সেই কর্মীরা আরেকটু ভাল বেতন পেতেন এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাও পেতে পারতেন।
উত্তরপ্রদশের মত রাজ্যগুলিতে কি তেমন প্রস্তাবই নেওয়া হয়েছে?
না। উত্তরপ্রদেশে আপাতত সমস্ত শ্রম আইন স্থগিত করা হয়েছে, এমনকি ন্যূনতম মজুরির আইনও।
আরও পড়ুন, কেন সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেল অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ?
ICRIER-এর রাধিকা কাপুর এ পরিস্থিতিকে শোষণের পক্ষে সুবিধাজনক পরিবেশ বলে আখ্যা দিয়েছেন। "এটা সংস্কার নয়। এর অর্থ স্থিতাবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়া, সমস্ত শ্রম আইন হঠিয়ে দেওয়ার অর্থ হল শ্রমিকরা শুধু ন্যূনতম অধিকার থেকেই বঞ্চিত হবেন না, তাঁদের মজুরি থেকেও বঞ্চিত হবেন।" যেমন, রাধিকার কথায় এবার কীভাবে সংস্থাগুলিকে সমস্ত শ্রমিককে ছাঁটাই করে, ফের তাঁদের কম মজুরিতে বহাল করা থেকে বিরত রাখা যাবে!
শ্রমিকদের দিক থেকে দেখল লকডাউনের শুরুতে যে সরকার সংস্থাগুলিকে কর্মী ছাঁটাই না করতে বলেছিল এবং পুরো মজুরি দিতে বলেছিল, তারাই এখন শ্রমিকদের দাবি দাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও শ্রমিকদের আরও বেশি আনুষ্ঠানিকতার প্রশ্ন তো দূরের কথা, এবার সংগঠিত শ্রমিকরাও অসংগঠিত শ্রমিকে রূপান্তরিত হবেন কারণ তাঁদের কোনও সামাজিক নিরাপত্তা রইবে না।
মজুরি কমবে কেন?
প্রথমত, ৩ নং ছবিতে দেখানো হয়েছে কোভিড-১৯ সংকটের আগেই, অর্থনীতির মন্দার কারণে মজুরি বৃদ্ধির হার কমছিল। সংগঠিত ও অসংগঠিত মজুরির হারের মধ্যে ফারাক বৃদ্ধি ঘটছিল। যেমন গ্রামীণ ভারতে একজন মহিলা যিনি খুচরো কাজ করেন তাঁর আয় শহুরে সংগঠিত ক্ষেত্রের পুরুষ কর্মীর মাত্র ২০ শতাংশ।
যদি সমস্ত শ্রম আইন বিলুপ্ত করা হয় তাহলে প্রায় সমস্ত নিয়োগই কার্যত অসংগঠিত হয়ে পড়বে এবং মজুরি কমবে ব্যাপক হারে। এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কাউর বলছেন, এ ব্যাপারে কোনও শ্রমিক কারও কাছে আর অভিযোগ জানাতেও পারবেন না।
এই বদলগুলির ফলে নিয়োগ বাড়বে এবং আর্থিক বৃদ্ধি কি ত্বরান্বিত হবে না ?
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে এর ফলে এমন একটা বাজার, যেখানে শ্রম বিধি অতি সামান্য, সেখানে শ্রমিক নিয়োগের পরিমাণ বাড়তে পারে। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, শ্রম আইন শিথিল করার ফলে, শ্রমিকদের স্বার্থ অরক্ষিত হওয়ার জেরে লগ্নির প্রচেষ্টা এবং নিয়োগের সংখ্যা বাড়েনি।
ইনস্টিট্যুট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের সেন্টার ফর এমপ্লয়মেন্ট স্টাডিজের ডিরেক্টর রবি শ্রীবাস্তব বলছেন বিভিন্ন কারণে নিয়োগ বাড়বে না।
প্রথমত, ইতিমধ্যেই বহুল পরিমাণ শক্তি অব্যবহৃত রয়েছে। সংস্থাগুলি ৪০ শতাংশ বেতন কাটছে এবং ছাঁটাই করছে। সব মিলিয়ে চাহিদা কমেছে। তাঁর প্রশ্ন কোন সংস্থা এখন বেশি নিয়োগ করবে।
আরও পড়ুন, কোভিড রোগীদের ডিসচার্জের সংশোধিত নীতিতে কী বলা হয়েছে
কাউর বলছেন, যদি বেশি মানুষকে নিয়োগ করাই উদ্দেশ্য হত, তাহলে রাজ্যগুলি কাজের সময় ৮ থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করে দিত না। তারা দুটি ৮ ঘন্টার শিফট করতে পারত, যাতে আরও বেশি মানুষ কাজ পান।
শ্রীবাস্তব ও কাপুর দুজনেই বলছেন এই পদশ্রেপ এবং তার ফলে মজুরি কমে যাওয়া সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে চাহিদা কমাবে, যা উন্নতির প্রক্রিয়ায় অন্তরায় হবে। কাপুরের কথায় সময়টা সম্পূর্ণ ভুলষ শ্রীবাস্তব বলছেন আমরা সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তায় হাঁটছি।
সরকার কি অন্য কিছু করতে পারত?
শ্রীবাস্তব বলছেন শ্রমিক শোষণের পরিস্থিতি তৈরি করার বদলে সারা বিশ্বের সরকার যা করেছে (৫নং ছবি), তেমনটা করতে পারত, শিল্পসংস্থার সংঙ্গে অংশিদারীতে যেতে পারত এবং জিডিপি-র ৩ থেকে ৫ শতাংশ মজুরির দায়ভার হিসেবে নিজের কাঁধে গ্রহণ করতে পারত, এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে পারত, কারণ কোভিজ যদি তাঁদের আক্মণ করে তাহলে সারা দেশ ডুবে যাবে।
এ ছাড়া শ্রমিক বিধির বাইরেও সংস্থাগুলি দক্ষ শ্রমিকের অভাব বোধ করবে এবং দুর্বল চুক্তি লাগু জনিত সমস্যাও বোধ করবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন