গত ১ মে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৯-এর দশকে মার্কিন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ফেড-এর ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকা অ্যালান ব্লাইন্ডার গুরুত্বপূর্ণ একটা দিকের কথা বলেছেন। ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আগের বারের সংকটের সময় অর্থনৈতিক সংকটের পর কর্মহীনতার ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমে আমরা আর্থিক সংকটে পড়ি, তার পর শুরু হয় ভয়াবহ মন্দা। এবার আমরা দেখছি কর্মহীনতা ঘটে চলেছে আর ফেড আর্থিক সংকট আটকাচ্ছে।”
এখানে উল্লেখযোগ্য হল এই উল্টো প্রক্রিয়া ভারতেও ঘটছে। রাস্তায় আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন, যদিও তাঁদের কাজের জোগানদার সংস্থাগুলি এখনও আর্থিকভাবে বরবাদ হয়নি। কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি না বদলায়, তাহলে আর্থিক সংকট হবেই এবং কর্মহীনতা স্থায়ী হয়ে পড়বে। কারণ স্বাস্থ্য সংকটের কারণে ভারত কতদিন লকডাউন চালাতে পারবে তার সঙ্গে যুক্ত হবে আর্থিক ভঙ্গুরতার বিপ্রতীপ দিক।
শিথিলতর লকডাউন ৩.০ কি বাড়াতে পারে বিপদ, কী বলছে সংখ্যার হিসেব?
এই বিতর্কের কেন্দ্রে অবশ্যই থাকবে এই বিপর্যয় কাটাতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। ভারতে এখনও পর্যন্ত আর্থিক ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
কিন্তু ব্লাইন্ডার দেখিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তিনি বলেছেন, “যখন বড়সড় ডলার অঙ্কের প্রশ্ন ওঠে, তখন ফেড জানে কী করতে হবে। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ে ঋণ দেওয়ার জন্য ফেড যথাযথ সংস্থা বলেই আমি মনে করি। ফেড পাইকারি হারে ঋণ দেওয়ার পক্ষে যথাযথ সংস্থা, কিন্তু খুচরো স্তরে নয়। এবং আরেকটা ব্যাপার হল, সব ব্যাপারে আপনি ফেডের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন না।”
অন্য দিক থেকে দেখলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অর্থনীতিতে কী করতে পারে তার একটা সীমা রয়েছে এবং যখন ক্ষুদ্রতম সংস্থাগুলি ধাক্কা খায়- তখন কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যতই চেষ্টা করুক, সে পরিস্থিতি বদলের নির্ণায়ক হিসেবে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলই।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অন্য ব্যাঙ্কগুলিকে নগদ জোগান দিতে পারে, কম সুদের হার স্থির করতে পারে - কিন্তু বিশ্বের তথা ভারতের ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথভাবেই উদ্বিগ্ন। তার চেয়েও বড় কথা ভারতের অর্থনীতিতে বহু ক্ষেত্র বিশেষ করে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলি তাদের অর্থের ব্যাপারে নির্ভর করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সে পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না।
ফলে ভারত যখন কিছু শিথিলতা সহ লকডাউন ৩.০-তে প্রবেশ করছে, তখন অর্থনীতির সামনে যে মূল প্রশ্ন, তা হল সরকার কখন কোনও রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করবে। কারণ, যত দিন যাচ্ছে তত বিষয়টা কর্মহীনতা থেকে আর্থিক সংকটের দিকে পৌঁছচ্ছে।
লকডাউনের আঁধারে বাংলার বই প্রকাশনার দুনিয়া
কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন ভারত সরকারের আরও ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে কিনা। অন্যরা মনে করিয়ে দিয়েছেন বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নেই বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে টাকা ছাপাতে বলার অর্থ মুদ্রাস্ফীতির দিকে এগোনো।
কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী পৃথিবীতে এই সমস্ত যুক্তিতর্কের অর্থ ছিল। কিন্তু কোভিড ১৯ অতিমারী গোটা পৃথিবীর আর্থিক চিত্র বদলে দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল আর্থিক সংস্থাই যদি যুক্তি সহ কাজ করে, তাহলে অর্থনীতি ধসে পড়বে।
তার কারণ ব্যাঙ্কগুলি মনে করবে ঋণ দেওয়া অনুচিত, উপভোক্তারা খরচের হাত কমাবেন, লগ্নিকারীরা থেমে থাকবেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের তাড়াবে এবং বেঁচে থাকার তাড়নায় খরচ কমাবে। কিন্তু এসবের ফলে অর্থনীতি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঢুকে পড়বে।
৪ মে ঠিক কোথায় কোথায় মদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার?
এ পরিস্থিতিতে সরকারই একমাত্র সংস্থা যারা যুক্তির বিধিকে অতিক্রম করতে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে আরও টাকা ছাপতে বলার মাধ্যমে তারা খরচ (এবং ফলত চাহিদা) তৈরি করতে পারে।
কিন্তু সরকার যদি ছোট সংস্থার সেফটি নেট না হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যেসব সংস্থা আগে ভালই চলছিল এবং কোভিড-১৯ লকডাউন যাদের বিপন্ন করে দিয়েছে, তাহলে আর্থিক দুর্দশা গভীরতর হবে এবং ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আশা করা যায়, সরকারের রিলিফ প্যাকেজ আসবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন কেবল তার সময় নিয়ে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন