গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী পালে নতুন হাওয়া লেগেছে, তার কারণ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে মে মাসে আড়াই মিলিয়ন নতুন কাজ যুক্ত হয়েছে। আমেরিকার ইতিহাসে এক মাসে এত কাজ আগে কখনও যুক্ত হয়নি।
লকডাউন শেষে মার্কিন অর্থনীতি দ্রুত সেরে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে, যার চেহারা হবে ইংরেজি “V”-এর মত।
প্রশ্ন হল, ভারত কি একই রকম ভাবে “V” চেহারা নিয়েই ঘুরে দাঁড়াবে? ভারতে তো আনলকিং শুরু হয়ে গিয়েছে। নাকি ভারতের লেখচিত্র “Z” বা “U” বা “L”-এর মত কোনও অন্য আকৃতির হবে?
এর উত্তর দেওয়ার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাব্য দৃশ্যগুলি।
অর্থনীতি কোন চেহারা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে তা কী কী বিষয়ের উপর নির্ভর করে, সেগুলি বোঝা প্রয়োজন। এর মধ্যে অতিমারীর পূর্ণ সময়কাল যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে চাকরি ও পারিবারিক রোজগারের উপর প্রভাব, সরকার কতটা আর্থিক সাহায্য করছে, ইত্যাদি বিষয়।
যেমন আর্থিক সমস্যা যদি স্বল্প সময়ের মধ্যে হয় যেখানে মানুষের রোজগার এবং তাদের খরচ করার ক্ষমতা উভয়ই সীমিত হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে লকডাউন ওঠার পর “Z” আকৃতির পুনরুদ্ধার সম্ভব (লেখচিত্র দেখুন, সূত্র- Hutchins Center of Fiscal & Monetary Policy at Brookings)।
এর ফলে অ্যাবসলিউট জিডিপি বর্তমান প্রবাহকে বদলে দিতে পারে বাড়তি চাহিদার জেরে। মনে করা যাক, যে সব অনুষ্ঠান, সালোঁয় যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়া, নতুন গাড়ি, বাড়ি ও গ্যাজেট কেনা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলি সব একত্রে ঘটতে থাকবে।
কিন্তু আর্থিক দুর্গতি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, যার ফলে বিভিন্ন কাজকর্ম পিছিয়ে না গিয়ে বাতিলই হয়ে গেল? যেমন এ বছর আর ইউরোপে গ্রীষ্মাবকাশ ঘটবে না। বা মাসিক চুল ছাঁটাই- তিন মাস পর সালোঁতে গেলে তো দুটি চুল ছাঁটাইজনিত আর্থিক ক্রিয়াকলাপ আর কখনও ঘটবে না।
এরকম পরিস্থিতিতে যদি ধরে নেওয়া হয় রোজগারহানি ও কর্মহানি স্থায়ী নয়, তাহলে আর্থিক বৃদ্ধি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে এবং ভেঙে পড়ার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। একে বলে “V” আকৃতির স্বাস্থ্যলাভ।
কিন্তু যদি অর্থনীতির স্বাস্থ্যলাভের গতি শ্লথ হয় এবং অর্থনীতি ভেঙে পড়ার জেরে বহু কাজ নষ্ট হয় ও মানুষের রোজগারহানি হতে থাকে, তাঁদের জমা অর্থে হাত পড়ে, তাহলে কী হবে?
সেক্ষেত্রে অর্থনীতি “U” আকৃতির পথ নেবে। এই প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে তা দীর্ঘায়ত “U” আকার ধারণ করবে। যেহেতু আমরা কোভিড ঘটিত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছি, সে ক্ষেত্রে “W” আকৃতির কথাও মাথায় রাখতে হবে। V আকৃতির স্বাস্থ্যলাভের পর, ফের যদি সংক্রমণের দ্বিতীয় স্রোত ঘটে এবং তার পর দ্বিতীয় বার অর্থনীতিও যদি স্বাস্থ্যলাভ করে, তেমন একটা ছবি তৈরি হতে পারে।
শেষ সম্ভাবনাটা নীতিপ্রণেতাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মত। একে বলে “L” আকৃতির স্বাস্থ্যলাভ। সরল করে বললে, এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতির এতটাই পতন ঘটে যে তা কয়েক বছরের মধ্যে জিডিপি-র পুরনো হালে ফিরতে পারে না। এই আকৃতিতে দেখা যায় অর্থনীতির উৎপাদনের সামর্থ্যের স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে।
ভারতের কী হবে সে প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। প্রায় সব অর্থনীতিবিদই একমত হয়েছেন যে এ বছর ভারতীয় অর্থনীতির সংকোচন হবে। মতপার্থক্য যা রয়েছে, তা হল কতটা সংকোচন হবে, সে নিয়ে। এর সীমা -৪ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন এ বছর অর্থনীতি তলানিতে ঠেকার পর আগামী অর্থবর্ষ থেকে তার হাল ফিরতে শুরু করবে।
তবে ভারতের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন বিস্তৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন ভারতের অর্থনীতি শুধু এ বছর নয়, ২০২১-২২-এও সংকুচিত হবে। তাঁর এই বিশ্লেষণ আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মতে ২০১৯-২০ সালের জিডিপি-তে ফেরত আসতে ২০২৩-২৪-এও ধুঁকবে ভারত। মনে রাখতে হবে সে বছরই এই সরকারের এই দফার শেষ বছর।
প্রণব সেন তাঁর বিশ্লেষণে বলেছেন, ২০২১-২২ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে -৮.৮ শতাংশ। এ ভাবনাটা ভয়ংকর কেননা এর অর্থ হল দেশ সম্পূর্ণ মন্দার মধ্যে চলে যাবে- যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম।
শেষ লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে, কোভিড সংকটের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ভারতে পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধাদানের অভাবে ভারতের অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত দীর্ঘায়ত U আকৃতির স্বাস্থ্যলাভ করবে।