Advertisment

লকডাউনের আঁধারে বাংলার বই প্রকাশনার দুনিয়া

ত্রিদিববাবুর আনুমানিক হিসেবে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৪ লক্ষ মানুষের এক লক্ষ ইতিমধ্যেই কর্মহীন। সকলকেই এবার অতি কঠোর কাটছাঁটের মধ্যে যেতেই হবে বলেও মনে করছেন তিনি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
College Street Lockdown

তখন প্রাণ ছিল বইপাড়ায় (ছবি- শশী ঘোষ)

কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে ব্যবসায় প্রতিবছর নতুন উদ্যোগপতিদের দেখা মেলে, তা হল প্রকাশনা। প্রতি বছর নতুন নতুন বই প্রকাশনা সংস্থা দেখা যায় বইমেলায়। সব মিলিয়ে ব্যবসার পরিমাণ খুব কম নয়। সেই বই প্রকাশনা শিল্প কোভিড-১৯ জনিত লকডাউনের ফলে কার্যত এখন বন্ধ।

Advertisment

বই প্রকাশনা বলতে সাধারণ ধারণা হল বইয়ের দোকান। কিন্তু একটি বইকে ফাইনাল প্রোডাক্ট হিসেবে ধরলে, তার আগে ঠিক কতগুলি ধাপ পেরোতে হয়, তা অনেকেরই অজানা। এর মধ্যে রয়েছে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, কাগজ কেনা-বেচা, মেশিনে ছাপা, বাঁধাই, এবং তা বইয়ের দোকানে পৌঁছনো। এখানেই শেষ নয়, কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা জানেন, সেখানে ফুটপাথের উপরের দোকানে বই কোনার জন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের ডাকেন কিছু মানুষ। তাঁরা কিন্তু সংশ্লিষ্ট দোকান কর্মী নন। বিভিন্ন দোকানের হয়ে কাজ করেন তাঁরা। এই পুরো ধাপগুলিই অসংগঠিত। কলকাতা তথা রাজ্যের বই প্রকাশনার প্রায় পুরো চেহারাটাই এরকম। ফলে মোট কত টাকার ব্যবসা হয় সারা বছরে, তার কোনও হিসেব কারও কাছেই থাকে না। আর টার্ন ওভারের হিসেব থাকে না বলেই, এই লকডাউনে বাংলার প্রকাশনা শিল্পে ক্ষতির পরিমাণও অজানা। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “বাংলার প্রকাশনা শিল্পের অনেকগুলি বিভাগ রয়েছে। বাংলার প্রকাশকরা ইংরেজি বই ছাপেন, বাংলা পাঠ্য বই ছাপেন, ইংরেজি পাঠ্য বই ছাপেন, এ ছাড়া সাহিত্য বিষয়ক বাংলা বই তো আছেই। শুধু বাংলা সাহিত্যের ভাগে বছরে আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।”

৪ মে ঠিক কোথায় কোথায় মদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার?

বাংলা প্রকাশনা জগতের সিংহভাগ ধরে রেখেছে আনন্দ পাবলিশার্স। প্রকাশনা সংস্থার তরফে সুবীর মিত্র জানালেন, “বইমেলার পর বাংলা নববর্ষের দিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। সেইদিন আমরা কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিলিত হই। এবার সেটা হল না, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের, নতুন বইয়ের প্রকাশনা হল না।”  লকডাউনের পর যে আর্থিক মন্দা তৈরি হবে, তার প্রভাব খুব দ্রুত বইবাজার কাটিয়ে উঠতে পারবে না আশঙ্কা সুবীরবাবুর। তিনি বললেন, “মানুষ তো তার প্রয়োজনীয় জিনিসটাই আগে কিনবে। তারপর ধীরে ধীরে আবার বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। ইতিমধ্যে প্রকাশনা শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে, তাও আমরা ধীরে ধীরে কাটিয়ে তুলব। তার জন্য হয় আমাদের বেশি কাজ করতে হবে, কিন্তু সে জন্য সবাই প্রস্তুত আছি।”

College Street Lockdown ফুটপাথে পুরনো বইয়ের পাহাড়ের এমন ছবি আবার কবে দেখতে পাওয়া যাবে কেউই জানেন না (ছবি- তাপস দাশ)

কলকাতার বইবাজার আপাতত খুলবে না বলেই মনে করছেন সপ্তর্ষি প্রকাশনীর সৌরভ মুখোপাধ্যায়। এবং যেদিনই খুলুক, ধীরে ধীরে পুরনো অবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে বলে মনে করেন তিনি। “যেভাবে বই প্রকাশনা শিল্প চলে, তাতে কোনওভাবেই সোশাল ডিসট্যান্সিং মানা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। এক জায়গা থেকে কাগজ কিনে ছাপাখানায় নিয়ে যাবার জন্য যে ভ্যানচালক বা মুটিয়ারা কাজ করেন, তাঁদের পক্ষে কীভাবে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব! এবং এখানেও চলে আসছে সেই অসংগঠিত শ্রমের বিষয়। যেসব মুটিয়ারা বা ভ্যানচালকরা বই নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা তো শুধু এই বইয়ের কাজই করছেন না। তাঁরা অন্য একটা সময়ে হয়ত লোহার পাইপ বইছেন। ফলে তাঁদের চিহ্নিত করাই সম্ভব নয়।”

দোকান খুলছে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স। পুলিশের অনুমতি নিয়েই। শুধু দোকান খোলা নয়, তারা সামাজিক দায়িত্বও পালন করছে। সপ্তাহে তিন দিন একবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে বইপাড়ার মুটে, ভ্যানচালক, বাঁধাইকর্মীদের জন্য, তাতে সহযোগিতা করছেন আরও কেউ কেউ। মিত্র ঘোষের কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কন্যা ইন্দ্রাণী রায়ের অনুযোগ,  এ উদ্যোগে প্রকাশকদের কেউ তেমন শামিল নন। তিনি জানালেন, “মার্চ মাস আমাদের ডিসকাউন্ট সেশন। বাংলা নতুন বছরে অনেক নতুন বই বেরোয়। সেগুলো সব আটকে গেল। আমাদের ৮৬ বছরের পুরনো প্রকাশনা, একটু বড় আকারেই অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু শুধু আমাদের তো নয়, সবারই এই ক্ষতি হয়েছে। এই সময়ে আমাদের ক্র্যাক ডব্লুবিসিএস নামের বইটা খুবই বিক্রি হয়। সেটাও হল না।” তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবে এত ক্ষতির মধ্যেও মিত্র ঘোষ পাবলিশার্স তাঁদের কর্মীদের বেতন দিয়েছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির টাকাও জমা দিয়েছেন। ইন্দ্রাণীর ক্ষোভ, কেন্দ্রীয় সরকার এমএসএমই-দের জন্য কোনও সাহায্যের কথা ঘোষণা করেনি। তাঁর আশঙ্কা, যদি তেমন ঘোষণা করা হয়ও, তাহলে তা ঋণ আকারে দেওয়া হবে। এই আকালে ঋণ নেবার আগেও তো সবাই ভাববেন। একইসঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ট্রেনের টিকিটের দাম ধার্য করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই না দিয়ে পুষ্পবৃষ্টির মত সিদ্ধান্তও হাস্যকর বলে অভিমত তাঁর।

কোভিড ১৯ আর লকডাউনে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বনাশ

সাইবার গ্রাফিক একটি ছোট সংস্থা, যারা ডিটিপি, ডিজাইন, প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড থেকে বাঁধাই পর্যন্ত সব রকম কাজ করে থাকে। তাঁদের সংস্থা থেকে কাজ হয় নেতাজি ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়ার পাবলিশার্স বা সৃষ্টিসুখের মত প্রকাশনার। এ ছাড়া কবি সম্মেলন, কৌরব বা ঐহিকের মত লিটল ম্যাগাজিনের কাজও করে থাকেন তাঁরা। কর্ণধার রাজীব রায়চৌধুরী জানালেন, গত দেড় মাস কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ। কিন্তু পিওডি মেশিনের ৩০ হাজার টাকা ইএমআই মার্চ মাসে দিতে হয়েছে। তাঁর কথায়, যখন মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের ইএমআই বন্ধের কথা ঘোষণা করা হল, ততদিনে মার্চ মাসের ইএমআই দিয়ে দেওয়া হয়ে গিয়েছে, কারণ ইএমআইয়ের টাকা সাধারণত মাসের গোড়ায় দিতে হয়। এ ছাড়া অফিস স্পেসের ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। ইলেক্ট্রিক বিলও রয়েছে। কর্মীদের বেতনের পুরোটা না হলেও একটা অংশ তিনি এখনও দিয়ে চলেছেন, তাদের সংসার চালাবার জন্য।  তিনি জানালেন, “এই মুহূর্তে যদি আমাকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে আমি শিয়ালদায় গিয়ে কাগজ কিনব কী করে! কাকে পাঠাব! কীভাবে পাঠাব! নতুন করে কাজ শুরু করবার সময়ে যদি সোশাল ডিস্ট্যান্সিং প্রথা চালু করতে হয়, তাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার একটা ১৫ বাই ১০ ঘর রয়েছে, সেখানে চারজন কাজ করেন। তাহলে কী করে সোশাল ডিস্ট্যান্সিং মানব!”

বেলঘড়িয়া অঞ্চলের বাসিন্দা বাঁধাইকর্মী উৎপল চক্রবর্তীর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বাঁধাইকর্মীদের রোজগার সাপ্তাহিক ভিত্তিতে। তিনি যে সংস্থায় কাজ করেন, সেখান থেকে তাঁর সাপ্তাহিক রোজগার ও ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে হাজার দশেক টাকাও হয় না। বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী ও তরুণী কন্যা। ফলে জমা টাকা বলতে কিছু নেই। তিনি জানালেন, “আমাদের চলছে রেশনের চাল আর রিলিফে। আমরা বাঁধাইকর্মীরা খুব খারাপ আছি। আমি না হয় একটা জায়গায় চাকরি করি, অনেকেরই বাঁধা কাজ নেই। তাদের অবস্থা আরও খারাপ। আমরা কোনও শিল্পের মধ্যে পড়ি না, আমাদের কথা বলার কেউ নেই। একটা ইউনিয়ন আগে বামফ্রন্ট জমানায় তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেও এখন আছে না নেই তাও জানি না।”

লকডাউনের সময়ে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত দৈনিক রোজগার যাঁদের, তাঁদের সহায়তার জন্য উদ্যোগী হয়েছে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম। 'অক্ষরবৃত্তে বন্ধুতা' নামের এই উদ্যোগে মানুষের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল গঠনের পরে পরেই সেখানে ১০ লক্ষ টাকা দিয়েছে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড।

College Street Lockdown প্রতীক্ষায় রয়েছেন পাঠকরাও (ছবি- শশী ঘোষ)

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বই প্রকাশনা ব্যবসায়ের এই দুর্বিসহ পরিস্থিতির কথা জানিয়ে গত ২১ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবসে চিঠি দেওয়া হয়েছে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের তরফ থেকে, জানালেন গিল্ড সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী সে চিঠির জবাবে লিখেছেন, স্ট্যান্ড অ্যালোন বইয়ের দোকান বিধি মেনে খোলা যেতে পারে। এবং অনলাইনে অনাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে বই বিক্রি করা যেতে পারে, জানালেন ত্রিদিববাবু। কিন্তু নিজের প্রকাশনা সংস্থা পত্রভারতী তিনি আপাতত খুলবেন না। “প্রথমত আমরা রেড জোনে পড়ছি, দ্বিতীয়ত খুলে কী লাভ! বইয়ের ক্রেতা কোথায়! যদি খুলিও তাতে এসট্যাবলিশমেন্ট কস্ট বাড়া বৈ কোনও লাভ নেই। ইতিমধ্যে বইয়ের বাজারে প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, এবং এটা কোথায় গিয়ে থামবে তার হিসেব করে ওঠা সম্ভব নয়।” তাঁর আশঙ্কা সামাজিক জমায়েত যদি দীর্ঘকালীন মেয়াদে বন্ধ থাকে, তাহলে বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল হতে পারবে না। সেসব জায়গায় বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। ত্রিদিববাবুর হিসেবে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৪ লক্ষ মানুষের এক লক্ষ ইতিমধ্যেই কর্মহীন। সকলকেই এবার অতি কঠোর কাটছাঁটের মধ্যে যেতেই হবে।

প্রুফ রিডারদের কাজ এখন বন্ধ বা প্রায় বন্ধ। এমনিতেই বাংলায় প্রুফ রিডারদের পারিশ্রমিক ভয়াবহ রকমের কম। প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জানাচ্ছেন, এক পাতা প্রুফ দেখলে পাওয়া যায় মাত্র ৭ টাকা। বছর তিনেক হল প্রুফ দেখছেন কৌশিক মিত্র। কত টাকা পান, তা বলতে তিনি নারাজ, তবে সে অর্থে গ্রাসাচ্ছাদন সম্ভব নয়, স্বীকার করে নিলেন তিনি। তাঁর ক্ষোভ, “যাঁরা প্রুফ দেখে এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁরা নিজেদের কাজটা কতটা গুরুত্বের সে কথা প্রকাশকদের বোঝাতে পারেননি, তাঁদের উপর চাপ দিতে পারেননি। ফলে এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।” তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর একটা আশা রয়েছে, “কাজ কমানোর জন্য বাংলা প্রুফরিডিং মেশিনের মাধ্যমে করে নেওয়া সম্ভব হবে না, তার কারণ বানানের রকমফের ও বিধি সংক্রান্ত ফারাকের জন্য মানব মস্তিষ্কের প্রয়োজন হবেই।”

কলকাতা বইপাড়ার অন্যতম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত দেজ পাবলিশিং। অপু দে জানালেন, সোমবার (৪ মে) থেকে দোকান খোলা হবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি তাঁরা। “যদি সকলে খোলা রাখে, তাহলে আর আমরাই বা বন্ধ রাখব কেন! তবে ক্রেতারা যদি যাতায়াত না করতে পারেন, তাহলে তো লাভ নেই।” লকডাউনের সময়ে তাঁদের ৩৫-৪০ জন কর্মীর সকলকেই পুরো বেতন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অপু দে। “তবে এ পরিস্থিতি চললে কতদিন পারব জানি না। তবে কারও চাকরি না রাখার কথা আমরা এখনও পর্যন্ত ভাবিনি। কোনও একটা পরিস্থিতিতে হয়ত দু পক্ষকেই কিছু অ্যাডজাস্ট করতে হবে।”

জনপ্রিয় লেখক প্রচেত গুপ্ত মনে করেন, “মানুষ লকডাউনের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে গিয়ে বুঝতে পেরেছেন বইয়ের কোনও বিকল্প নেই। কতক্ষণ আর মানুষ টিভি দেখতে পারে, মোবাইলে ঝুঁকে পড়তে পারে, কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনতে পারে! যাঁরা অভ্যস্ত নন, তাঁরাও ধুলো ঝেড়ে পুরনো বই বের করে নিয়ে পড়েছেন এই সময়ে। তাঁরা ফের বইয়ের কাছেই ফিরবেন।”

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ছোটদের বই প্রকাশ করে ওরিয়ল পাবলিকেশন। সংস্থার প্রবীর দে বললেন, তাঁরা অথৈ জলে পড়েছেন। তার জন্য শুধু লকডাউনই অবশ্য দায়ী নয় বলে মনে করছেন তিনি। তিনি জানালেন, তাঁদের প্রি নার্সারির কিছু বই দু বছর ধরে কিনে নিয়েছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। তাঁর কথায়, মুখ্যমন্ত্রী স্থিরও করে দিয়েছিলেন কোন কোন বিষয়ের বইয়ের উপর জোর দিতে হবে। সেই মোতাবেক বই প্রকাশিত হলেও, ২০১৯ সালে সরকার একটি বইও কেনেনি, অথচ বিভিন্ন জায়গায় বই জমা করতে বলা হয়েছে। তাঁরা সে সব নির্দিষ্ট স্থানে বই জমা করেছেন বটে, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। ফলে গত বছর থেকেই তাঁদের মত প্রকাশকদের বিপন্নতা শুরু। এবছরের শুরুতে তাঁরা বেশ কিছু বই বুকসেলারদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছেন, যার পেমেন্ট পাওয়ার কথা মার্চ মাস থেকে। সেই লক্ষাধিক টাকার পেমেন্ট এখন আটকে। ফলে বিপদ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর স্পষ্ট আবেদন, “মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দয়া করে ১০ লক্ষ টাকা করে ঋণ দিন, অনুদান আমরা চাই না। বই তো শাকসব্জি মাছ মাংস নয়, যে দোকান খোলার অনুমতি দিলেই ক্রেতারা চলে আসবেন। সমস্ত পরিবহণ বন্ধ, লোকে আসবে কী করে! বই ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতিপূরণে রাজ্য সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।”

বই ব্যবসা লকডাউনের পর অন্য ব্যবসার চেয়ে দ্রুতগতিতে সুস্থতার পথে এগোবে বলে আশা করছেন লেখক দেবতোষ দাশ। তিনি মনে করেন, “বহু মানুষের কাছে বই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। যদি অনলাইন বই ব্যবসা যথাযথভাবে করা যায়, তাহলে বহু মানুষ বই কিনবেন। তুলনায় হয়ত কলেজ স্ট্রিট গিয়ে বই কেনার প্রবণতা কমবে। কিন্তু বই বিক্রি বাড়বে। লকডাউনের সময়ে দেখা গেল বই কীভাবে ডিপ্রেশন থেকে বাঁচিয়ে দেয়। সে কথা মাথায় রেখেই মানুষ বইয়ের দিকে ঝুঁকবেন।”

প্রকাশনা ব্যবসায়ে শতবর্ষ অতিক্রম করে ফেলেছে দেব সাহিত্য কুটীর। ঐতিহ্যশালী এই প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ৬০। সংস্থার তরফে রূপা মজুমদার জানালেন, এই লকডাউনের সময়ে দোকান খোলা রাখার প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাঁর আশঙ্কা শুধু লকডাউন নিয়েই নয়। “লকডাউন পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির যে পরিস্থিতি হবে, তাতে বিনোদনের জন্য কত লোক বই কেনায় খরচ করার ব্যাপারে আগ্রহী হবেন, সে নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।” তবে তাতেও ব্যবসা বন্ধ করার কথা ভাবছেন না তাঁরা। রূপার কথায়, যাঁরা শখের বই ব্যবসায়ী তাঁরা এ রকম ভাবতে পারেন। “আমাদের সরাসরি ৬০ জন কর্মী, অপ্রত্যক্ষভাবে হিসেব করলে সংখ্যাটা ১৫০ ছাড়াবে। এতগুলো সংসার প্রতিপালনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারব না। হয়ত নতুন কৌশল নিতে হবে। অনলাইনে বই বিক্রি, ই বুক, অডিও বুকের মত বিষয়, যা আমরা আগেই পরিকল্পনা করছিলাম, সে কাজে আরও মনোযোগ দিতে হবে, আরও ত্বরান্বিত করতে হবে।” এই লকডাউনের সময়েও সকল কর্মীদেরই পুরো বেতন দিচ্ছে সংস্থা, জানিয়েছেন তিনি।

দোকান খোলা বা না-খোলা প্রসঙ্গে ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, "গিল্ড তো কোনও নিয়ামক সংস্থা নয়, তারা কাউকে নিষেধ করতে বা অনুমতি দিতে পারে না।" তেমন কোনও নিয়ামক সংস্থা বাংলা প্রকাশনা জগতে নেইও। বইমেলার  ১২ দিন ছাড়া আর কোনও সময়ে সেখানে সরকারের উপস্থিতি নজরে পড়ে না।

সপ্তর্ষি প্রকাশনীর সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “করোনা আর লকডাউন পরিস্থিতি বাংলা বই প্রকাশনা জগতের অপেশাদারি দিকের হাড়মজ্জা বের করে দিয়েছে।”

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Lockdown COVID-19
Advertisment