প্রায় সাড়ে তিন মাস হল ভারত জুড়ে মাল্টিপ্লেক্স ও সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। করোনাভাইরাস অতিমারীর জেরে এই বন্ধের কারণে ফিল্ম জগতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফিল্ম জগতে এ নিয়ে উদ্বেগ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়েও।
মার্চের মাঝামাঝি সুজিত সরকার পরিচালিত ছবি গুলাবো সিতাবো ১২ জুন প্রাইম ভিডিওতে রিলিজ করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর্থিক টানাটানি যে কোন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে, তা বোঝার জন্য এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট। এই স্ট্রিমিং পরিষেবার তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে আরও ৬টি ছবির প্রিমিয়ার হবে তাদের প্ল্যাটফর্মে, যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যা বালান অভিনীত শকুন্তলা দেবীর বায়োপিকও।
সুজিত সরকার বলেছেন, ছবি যখন তৈরি তখন তিনি না বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এমন পদক্ষেপ করেছেন যাতে তাঁর টিম এই চুক্তি থেকে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং পরের কাজের পোস্ট প্রোডাকশন শেষ করতে পারে। সুজিত সরকারের এ হেন সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে আইনক্স ও পিভিআরের মত মাল্টিপ্লেক্সগুলি।
এঁরা সোমবার ২৯ জুন ফের ধাক্কা খেয়েছেন ডিজনি প্লাস হটস্টারে অক্ষয় কুমার অভিনীত লক্ষ্মী বম্ব ছবি মুক্তির ঘোষণায়। আরও ৬টি ছবি এই প্ল্যাটফর্মে দেখানো হবে, যার মধ্যে রয়েছে অজয় দেবগণ ও সঞ্জয় দত্ত অভিনীচ ভুজ-দ্য প্রাইড অফ ইন্ডিয়া, সুশান্ত সিং রাজপুতের দিল বেচারা, আলিয়া ভাট ও আদিত্য রায় কাপুর অভিনীত সড়ক ২, অভিষেক বচ্চনের দ্য বিগ বুল, বিদ্যুৎ জামওয়ালের খুদা হাফিজ এবং রসিকা দুগ্গল ও কুণাল খেমুর লুটকেস।
কার্নিভ্যাল সিনেমাস-এর সিইও মোহন উমরতকর বলেছেন, ছবির নির্মাতাদের প্রথমে ডিজিটালের পথ বেছে নেবার সিদ্ধান্ত খুবই দুর্ভাগ্যজনক, বিশেষ করে যথন সারা দেশে ফের সিনেমা হল খুলে ছবি রিলিজ করার ব্যাপারে আমরা মাত্র কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছি... যদি হলে রিলিজ করার জন্য তৈরি ছবি সরাসরি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে চলে যায়, তাহলে সব মিলিয়ে ইকোসিস্টেমের বৃদ্ধি বিপর্যস্ত হবে।
ভারতের সিনেমা হল রিলিজ থেকে লাভের ভাগাভাগি কীরকম হয়?
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের প্রোডিউসাররা সবচেয়ে বেশি অর্থলাভ করে থাকেন বক্স অফিস সংগ্রহের রিটার্ন থেকে। উমরোতকার বলেন, যদি একটা ছবি ভাল করে, ৬০-৭০ শতাংশ রোজগার হয়ে থাকে বক্স অফিস থাকে, দেশ ও বিদেশ থেকে।
তিনি বলেন, বিদেশের মার্কেট থেকে সিনেমাহলের কালেকশন থেকে আসে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। যত বেশি সিনেমার বক্স অফিস সংগ্রহ, উপগ্রহ, ওটিটি ও মিউজিক রাইটস থেকে রোজগার বেশি। সিনেমা হলে চলতে থাকা বিষয়টির আলাদা গুরুত্ব দেয়।
প্রদর্শকদের মধ্যে বিশেষ করে মাল্টিপ্লেক্স ও প্রযোজকদের মধ্যে প্রফিট শেয়ারিং অতীতে বিবাদের বিষয় ছিল। যদিও সে সমস্যার সমাধান হয়েছে কোনও কোনও ক্ষেত্রবিশেষে আলোচনার মাধ্যমে, তবে তাদের বোঝাপড়া মূলত ইনফর্মাল।
ট্রেড অ্যানালিস্ট গিরিশ জোহর বলেন, ট্যাক্স কাটার পর এই প্রযোজক ও প্রদর্শকরা বক্স অফিস সংগ্রহ ভাগাভাগি করে নেয়। প্রথম সপ্তাহে প্রযোজক লাভের ৫০ শতাংশ নেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রযোজক পান ৫০ শতাংশ, এবং তৃতীয় সপ্তাহে তাঁদের শেয়ার হয় ৩৫ শতাংশ।
কোনও ছবি ভাল ব্যবসা করলে এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে প্রযোজক প্রথম সপ্তাহে লাভের ৫২.৫ শতাংশ ও দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪৭ শতাংশ পান। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বোঝাপড়া অপরিবর্তিতই থাকে।
হলের রিলিজ এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আইম্যাক্স ও ৪কে রেজলিউশনের মত প্রযুক্তিগত উন্নতি, লেজার প্রজেকশন, দুর্ধর্ষ সারাউন্ড সাউন্ড, সব মিলিয়ে সিনেমাহলের আরামপ্রদ চেয়ারে বসে পপকর্ন খেতে খেতে সিনেমা দেখার যে অভিজ্ঞতা, তা বাড়ি বসে স্মার্ট টিভির পর্দায়, ল্যাপটপে, ট্যাবলেটে বা মোবাইল ফোনে সম্ভব নয়।
ভায়াকম ১৮ স্টুডিওজের সিওও অজিত আন্ধারে বলেন, অন্ধকার ঘরে, অনেকের সঙ্গে বড় পর্দায়, লার্জার দ্যান লাইফ ছবি দেখার যে অভিজ্ঞতা তা অনন্য। এ অভ্যাসের বদল অন্তত ভারতে খুব তাড়াতাড়ি বদলাবে না।
এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্স শপিং মলে অবস্থিত যেখানে ফুড কোর্টও থাকে, ফলে সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে একটা সামাজিক ঘটনা, পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লম্বা আউটিং এবং সঙ্গে খাওয়া দাওয়াও।
ভারতে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের বাড়বাড়ন্ত কবে থেকে?
গত চার বছর ধরে ভারতে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলি পুরনো ও নতুন ছবি সংগ্রহ করেছে, তথ্যচিত্র দেখিয়েছে এবং নিজেদের কনটেন্ট কমিশন করেছে। যদিও অনেক ছবি পরিচালকই বক্স অফিসের সাফল্যের কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করেছেন।
আন্ধারে বলেন, আমরা যেসব ছবিকে ছোট ও ডিজিটাল বলে দাগিয়ে দিই সেগুলোও বক্স অফিসের কথা মাথায় রেখেই লেখা হয়। ব্যবসার দিক থেকে দেখলে এগুলি প্রাথমিক ভাবে হলে দেখানো উচিত কারণ আয়ের একটা বড় অংশ আসে টিকিট বিক্রি থেকে।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে এবং হলে ছবি ও শোয়ের উপভোগের ধরন ভিন্ন। আন্ধারের কথায়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দর্শকরা মূলত কনটেন্ট দেখেন। গোটা কনটেন্ট ডিজাইন করা হয়ে থাকে, বিশেয করে ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে, যাতে প্রতি ওয়েব সিরিজের প্রতি এপিসোডের শেষে একটা ক্লিফহ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকে। অবশ্যই কোনও ছবি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের জন্যই বানানো যেতে পারে, এবং এখন প্রায়শই তেমনটা ঘটবে।
যদিও স্ট্রিমিং সার্ভিস অন্য ধরনের ছবি তোলে, তাহলেও তাদেরও ফেভারিট রয়েছে। সাধারণত শাহরুখ খান, আমির খান, সলমন খান ও অক্ষয় কুমারের ছবির ডিল সবচেয়ে ভাল হয়। আয়ুষ্মান খুরানা ও রণবীর সিংয়ের ছবিরও ভাল ডিল হয়।
ডিজিটালে প্রিমিয়ার সকলের জন্য সেরা অপশন নয় কেন?
যশ রাজ ফিল্মস ও রিলায়েন্স এন্টারটেনমেন্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা তাদের নতুন ছিব ওটিটি-তে রিলিজ করবে না। কবীর খানের ৮৩ বা রোহিত শেট্টির সূর্যবংশীর প্রোডাকশন বাজেট খুবই বেশি। যদি তাদের সিনেমা রিলিজ মিসও হয়, তাহলে তাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ডিল থেকে টাকা উঠবে না।
গিরিশ জোহর বলেন, ১০ কোটি টাকার ছবির প্রিমিয়ার স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে হতে পারে, কিন্তু ১০০-১৫০ কোটি টাকার ছবির নয়। যাঁরা বড় প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা স্বভাবতই কম কিছুতে আগ্রহী হবেন না। মূলত ছোট প্রোডাকশন সংস্থাই ডিসট্রেস সেলে রাজি হয়।
ছোট প্রযোজকদের পক্ষে বাজার থেকে টাকা ধার করে বানানো প্রোডাক্ট ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাঁদের অফিস ভাড়া দিতে হয়, কর্মীদের মাইনে দিতে হয়। গোটা শৃঙ্খলের জন্যই সিনেমা হলে ছবির মুক্তি সিনে অভিজ্ঞতার মূল বিষয়। লকডাউনের সময়ে সিনেমার ডিজিটাল প্রিমিয়ার এ মডেলের মৌলিক বদল ঘটানো সম্ভব নয়।
সিনেমা হল কবে কীভাবে খুলতে পারে?
সোমবার ২৯ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ে আনলকডাউনের যে গাইডলাইন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সিনেমা হল খোলার কথা নেই। কিন্তু অনেক প্রদর্শকরা নিশ্চিত যে স্বাভাবিকতা ফিরলে ফের দর্শকরা সিনেমা হলে বিশাল সংখ্যায় হাজির হবেন।
তবে গোটা অভিজ্ঞতায় বদল ঘটবে- পরিচ্ছন্নতা, সোশাল ডিসট্যান্সিং, এবং তাপমাত্রা মাপা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। উমরোতকার বলেন আমরা সরকারের কাছে সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে একগুচ্ছ প্রস্তাব পাঠিয়েছি। কেই সিট বুক করলে পাশের সিট ব্লক করা হবে এবং তা বুকিং করা যাবে না।
সিনেমা হল খোলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের মানুষের বেঁচে থাকাও। তিনি বলেন, এক একটি স্ক্রিনের সঙ্গে সরাসরি ২০ জন যুক্ত, ততজনই যুক্ত পরোক্ষভাবে।
ভারতে ৯৫০০ স্ক্রিন রয়েছে, যেখানে দৈনিক টিকিট বিক্রি হয় ৩০ কোটি টাকার। এর অর্ধেক মাল্টিপ্লেক্স, বাকিগুলি সিঙ্গল স্ক্রিন। সিনেমা হল মূলত মেট্রো, টায়ার ১ ও টায়ার ২ শহরে রয়েছে। উমরোতকর বলেন, এখানে ভারতের বাড়ার সুযোগ রয়েছে। আমেরিকা ও চিনে প্রায় ৫০ হাজার করে স্ক্রিন রয়েছে।