কোভিড-১৯ অতিমারীর জন্য সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ব্যাপক সংকটের মুখে। ২০২০ সালের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটের পর সবচেয়ে বিপন্নতার মুখে পড়তে চলেছে। কিন্তু বিলিয়নেয়াররা, অন্তত তাঁদের একাংশ গত তিন মাসে তাঁদের সম্পদ বাড়িয়ে ফেলেছেন, যে তিন মাস সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছে আর্থিকভাবে দুঃসহ হয়ে উঠেছে।
আমেরিকায় বিলিয়নেয়াররা ১৮ মার্চ থেকে ৫৬৫ বিলিয়ন বেশি ধনী হয়েছেন বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি-র পলিসি স্টাডিজ ও ক্লিয়ারওয়াটার, ফ্লোরিডার সংস্থা আমেরিকানস ফর ফেয়ার ট্যাক্সেশন। আমাজনের প্রধান জেফ বেজোস একাই ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬.২ বিলিয়ন ডলার বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন। এই সময়কালে ৪৩ মিলিয়ন আমেরিকান কর্মহীনতার সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।
এর ব্যাখ্যা কী?
আমেরিকায় স্টক মার্কেটের ঘুরে দাঁড়ানোই এর প্রধান কারণ।
আমেরিকায় কোভিড-১৯-এর ব্যাপক বৃদ্ধি ও ৪৩ মিলিয়ন আমেরিকান কর্মহীনাতর সুবিধার আবেদন সত্ত্বেও নাসডাক প্রায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌছিয়েছে। লগ্নিকারীরা বড় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা, বড় ওষুধ সংস্থা ও হাসপাতালের সরঞ্জামের সঙ্গে যুক্ত সংস্থার শেয়ার কিনছেন।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে আমাজন প্রায় ৫০ শতাংশ রোজগার বাড়িয়েছে, এমনকি ফেসবুকও মার্চ মাসে যে পরিস্থিতি ছিল তা কাটিয়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছিয়েছে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গের সম্পত্তি ১৮ মার্চ থেকে প্রায় ৩০ বিলিয়ন বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়া যেসব প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ধনীরা গত তিন মাসে তাঁদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন টেসলার এলন মাস্ক, গুগল প্রতিষ্ঠাতা সের্গেভ ব্রিন ও ল্যারি পেজ এবং মাইক্রোসফটের প্রাক্তন সিইও স্টিভ বালমের। এঁদের সম্পত্তি ১৮ মার্চ ছেতে বৃদ্ধি পয়েছে ১৫ বিলিয়ন বা তার বেষি। জুমের প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও এরিক উয়ানের সম্পত্তিও অতিমারীর সময়ে ব্যাপক বৃ্দ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাণ ২.৫৮ বিলিয়ন বলে জানা গিয়েছে। ওয়ালমার্টের অন্যতম অংশিদার ওয়ালটন পরিবারের সম্পত্তিও ব্যাপক বেড়েছে। জিম, অ্যালিস ও রব ওয়ালটন, সকলেই ১৯ মার্চের পরের তিন মাসে ৩ বিলিয়ন করে বেশি সম্পদের অধিকারী হয়েছেন।
আমেরিকার অতিমারীর কারণে নিয়োগহীনতার ২৮.৫ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চেয়ে যা তিনগুণ বেশি। গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ে যা কর্মহীনতা ছিল তাকে ছাড়িয়ে এবারের হার ২০ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুধু বিলিয়নেয়ররাই নন, স্টক মার্কেটে যাঁরা লগ্নি করেছেন তাঁরাও লাভ করেছেন।
গোটা বিশ্বের ধারাবাহিকতা কীরকম?
অতিমারীর তিন মাস সময়ে অন্তত প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছু বিলিয়নেয়ার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ১০৬২ জন বিলিয়নেয়র ক্ষতিগ্রস্ত, বিলিয়নেয়ার তালিকা থেকে নেমে গিয়েছেন ২৬৭ জন। ২০১৯ সালে বিলিয়নেয়রদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, তা ২০২০ সালে হয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন। ফোর্বসের রিপোর্টে জানানো হয়েছে বিলিয়নেয়র তালিকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা গত বছরের তুলনায় ৫১ শতাংশ দরিদ্র হয়ে পড়েছেন।
অতিমারী ও লকডাউনের ফলে মূলত লাভ করেছে অনলাইন রিটেল কোম্পানি ও প্রযুক্তি সংস্থা। গত দুমাসে যাঁরা লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চিনের সোশাল শপিং জায়েন্ট সংস্থা পিনডুয়োডুয়ো-র তলিন হুয়াং ঝেং। স্প্যানিশ রিটেল ব্র্যান্ড ইনডিটেক্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমানিকো ওর্টেগা গত দুমাসে লাভের মুখ দেখেছেন।
গত চার মাসে যাঁদের ক্ষতির পরিমাণ সব চেয়ে বেশি তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বার্কশায়ার হাথাওয়ের ওয়ারেন বুফে, এলভিএমএইচ সংস্থার চেয়ারম্যান বার্নার্ড আর্নল্ট, পৃথিবীর বৃহত্তম বিলাসদ্রব্য সংস্থা ও মেক্সিকোর টেলিকম বিলিয়নেয়র কার্লোস স্লিম হেলু।
ভারতের বিলিয়নেয়রদের কী অবস্থা?
হুরুন রিসার্চের রিপোর্ট অনুসারে রিলায়েন্স কর্ণধার মুকেশ আম্বানি বিশ্বের অষ্টম ধনীর তালিকায় উঠে এসেছেন, যুগ্মভাবে তিনি এখন এ স্থানে রয়েছেন গুগলের সহ প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে। এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি জানুয়ারির ৩১-এ কোভিড-১৯ অতিমারীর আগে যে স্থানে ছিলেন, তার চেয়ে একধাপ উঠে এসেছেন।
সিরাম ইনস্টিট্যুটের সাইরাস পুনাওয়ালার সম্পত্তি ভারতীয় বিলিয়নেয়রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দ্রুতহারে বেড়েছে, বিশ্বের হিসেেব তাঁর সম্পত্তি বৃদ্ধির হার পঞ্চম। পুনের এই উদ্যোগপতির সম্পত্তি বৃ্দ্ধি গত চার মাসে ২৫ শতাংশ। তাঁর সংস্থা সিরাম ইনস্টিট্যুট অফ ইন্ডিয়া বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন নির্মাতাদের অন্যতম এবং এই সংস্থা ইতিমধ্যেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি ভ্যাকসিনের এক লক্ষ ডোজ উৎপাদনের জন্য আসট্রাজেনকার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছে।
এর প্রভাব কী?
হ্যাভ ও হ্যাভ নটদের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বিভাজন আমেরিকায় অসন্তোষের আগুনে ঘি ঢালতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞ চাক কলিন্স বলেছেন, বিলিয়নেয়রদের অতিমারীর মধ্যে সম্পত্তি বৃদ্ধি দেখিয়ে দিয়েছে আত্মদানের অসাম্যের কুরূপটিকে।
ভারতের ক্ষেত্রে মনে রাখার, এই সংকট শুরুর আগেই ধনী তালিকা দেশের অর্থনীতির মন্দার ব্যাপারে উদাসীন থেকেছে। হুরুন সংস্থার এমডি আনাস রহমান জুনেইদ বলেছেন, ভারতের বিলিয়নেয়ররা কাঠামোগত যে মন্দা তার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছেন, এতে তাঁদের বৃদ্ধির কোনও অসুবিধা হয়নি।