এইমসের ডিরেক্টর তথা ভারতের বিশিষ্ট ফুসফুস বিশেষজ্ঞ রণদীপ গুলেরিয়া কোভিড ১৯ মোকাবিলা কৌশল সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য। এ ছাড়াও কোভিড ১৯ রোগীদের চিকিৎসারত ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগরক্ষাকারী ন্যাশনাল টেলিকনসাল্টেশন সেন্টারের শীর্ষেও রয়েছেন।
১২ মার্চ থেকে ভারত কার্যকরী ভাবে সীমান্ত বন্ধ করেছে। এর পর থেকে আপনি কিসে কিসে বিস্মিত হয়েছেন?
আন্তর্জাতিক স্তরের কথা বললে আমি বিস্মিত হয়েছি যেভাবে কিছু দেশ এই অতিমারীকে লক ডাউনের সাপেক্ষে হালকাভাবে নিয়েছে। কী করে যেন তারা ভেবেছে ভাইরাস তাদের ওখানে যাবে না। চিনের পরিস্থিতি দেখবার পর এদের বোঝা উচিত ছিল, সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন ছিল।
আমাদের দেশে আমি বিস্মিত হয়েছি প্রধানমন্ত্রীর জনতা কার্ফিউয়ের আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায়, এর গুরুত্ব বুঝেও কোনও কোনও গোষ্ঠী তা মানে নি। এটা একটা নাগরিক আন্দোলন, এ যুদ্ধ যদি আমাদের জিততে হয়, তাহলে তা কমিউনিটির পর্যায়ে জিততে হবে, হাসপাতাল পর্যায়ে নয়। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা হয়, কমিউনিটিই অতিমারী রোধ করতে পারে।
যেমন টেস্টিং। অনেকেই বলছেন আরও বেশি সংখ্যক মানুষের টেস্টিং করানো উচিত। কিন্তু তার পিছনে কিছু কারণ তো থাকতে হবে। প্রথম প্রশ্ন হল, তাঁরা কি বিদেশ থেকে এসেছেন! সে কারণেই কোয়ারান্টিন ও টেস্টিং তাঁদের ও তাঁদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাঁদেরই করা হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে নজরদারির পরিসংখ্যান খুব ভাল। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা আশা কর্মীদের স্তর থেকে নজরদারি উপরের স্তরে উঠতে থেকেছে। ফ্লুয়ের মত উপসর্গ কারও দেখাদিলে বা তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ ভর্তি হলে তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর ফলে কোনও জায়গায় সামূহিক কিছু নজরে পড়ছে কিনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।সকলকে টেস্টিং করাবার জন্য বিশাল পরিকাঠামো লাগবে এবং তা থেকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্যও পাব না। যেখানে প্রয়োজন সেখানে টেস্টিং হচ্ছে এবং তার মাধ্যমে নীতিপ্রণেতারা সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন।
ধরুন কোনও একজন ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে মৃত্যুপথযাত্রী এবং তিনি কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হলেন ও মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু কি করোনাভাইরাস জনিত?
কোভিড সংক্রান্ত জটিলতায় যদি কেউ মারা যান, তাহলে তাঁর মৃত্যু কোভিড ১৯ জনিত। ৮০ শতাংশ কোভিড ১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি সামান্য অসুস্থতার পর মারা যান। যদি কোনও মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর কোভিড ১৯ জনিত নিউমোনিয়া ও সেপসিস হয় এবং তিনি মারা যান, তাহলে তাঁর মৃত্যু কোভিড কারণে। কোভিড ১৯ যদি তাঁর শ্বাসের সমস্যার কারণ না হয়ে থাকে, তাহলে তা কোভিড ১৯ সংক্রান্ত মৃত্যু নয়।
সকলেই বলছে গোষ্ঠী সংক্রমণ সবচেয়ে বিপজ্জনক। এটাকে কীভাবে বুঝতে হবে?
অতিমারীতে কোনও না কোনও সময়ে গোষ্ঠীসংক্রমণ হবেই। আজ বন্ধ কিন্তু একসময়ে তো ভ্রমণ চালু হবে। সে সময়ে কেউ কেউ সংক্রমণ নিয়ে আসবেন এবং অন্যদের সংক্রমিত করবেন।
এটা প্রশ্ন নয় যে আমরা সারা জীবন গোষ্ঠী সংক্রমণ আটকে রাখতে পারব কিনা। আমরা যা দেখছি তাহল আমরা কি শুরুতে ব্যাপক পরিমাণ গোষ্ঠী সংক্রমণ আটকাতে পারি। সেটা পারলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর কম প্রভাব পড়বে এবং আমরা চিকিৎসার বিভিন্ন উপায় দেখতে পারব।
কিন্তু আমরা কখনওই গোষ্ঠী সংক্রমণের মধ্যে যাব না, এটা ঠিক কথা নয়। কিছু গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটবেই। আমাদের লক্ষ্য হল তাকে কমিয়ে রাখা, আটকে রাখা, স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ রাখা।
লকডাউন ১০ দিন অতিক্রান্ত। এর যে আর্থিক অভিঘাত সে কথা মাথায় রেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে মৃত্যুহার যখন এত কম এবং ভারতের জনসংখ্যার বড় অংশই যেহেতু অল্পবয়সী, সে কথা মাথায় রেখে এরকম একটা সিদ্ধান্ত কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল...
এটা ঘটনা যে আমাদের জনসংখ্যার গড় বয়স ইতালির চেয়ে কম। মৃত্যুহার বয়স্কদের মধ্যে বেশি।
তবে আমাদের বুঝতে হবে যে ভারতের জনসংখ্যা বেশি এবং আমাদের এখানে যদি ব্যাপক বিপদ না ও হয় তাহলেও বড় সংখ্যক মানুষকে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।
আমাদের আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। আমাদের জনসংখ্যার গড় বয়স কম হলেও অন্যান্য অসুখের সংখ্যা বেশি। ভারত পৃথিবীর জায়াবেটিক রাজধানী। পশ্চিমে যে বয়স থেকে হৃদরোগ শুরু হয় আমাদের এখানে তা শুরু হয়, তার ১০ বছর আগে থেকে। ফলে লকডাউন সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল।
বিশাল পরিমাণ মহামারী হলে তাতে যে পরিমাণ মৃত্যু ও আর্থিক ক্ষতি হত তার চেয়ে লকডাউনের আর্থিক ক্ষতি বেশি সহনীয় বলে আমার বিশ্বাস।
ভারতে রোগের বৃদ্ধির হার পশ্চিমের অন্য দেশগুলির মত নয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারের কী করা উচিত?
আমার কাছে বিষয়টা হল দ্রুত পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া। প্রথমত, লকডাউন কি চালিয়ে যাওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত সারা দেশে কি লকডাউন থাকা উচিত, নাকি তৃতীয়ত কিছু কিছু জায়গা থেকে তা তুলে নেওয়া উচিত। এগুলো সবই পরিসংখ্যান নির্ভর হওয়া প্রয়োজন। রোগীর সংখ্যা, হটস্পট, কোথায় কোথায় কম বিপজ্জনক।
আমাদের ভাগ্য ভাল যে আমাদের রোগীর সংখ্যা আকাশচুম্বী নয়। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের বসে থাকলেও চলবে না। কোনও কোনও এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে আমাদের আরও আগ্রাসী হতে হবে। এসব জায়গায় টেস্টিংও বাড়াতে হতে পারে।
এই অতিমারীর নতুন চ্যালেঞ্জগুলি কী? পিপিই এবং ভেন্টিলেটর অপ্রতুল, এ কথা অনেকেই বলছেন।
এটা অনেক দিক থেকেই অভূতপূর্ব অতিমারী। এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হল এর জেরে নিউমোনিয়া হয় ও শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে।এর সুরক্ষা ও চিকিৎসা দুইই উচ্চমার্গের।
জলবাহিত অতিমারী সামলানো সবচেয়ে সহজ।
কিন্তু এক্ষেত্রে তা নয়। এখানে হাসপাতালগুলোর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ক্রিটিকাল কেয়ারের পরিকাঠামো বৃদ্ধি। কীভাবে আমরা ভেনটিলেটরের সংখ্যা বাড়াতে পারি বা পিপিই আরও বেশি পেতে পারি।
আরও জরুরি হল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে থেকে শঙ্কা দূর করা। অনেকেই নিজেরা সংক্রমিত হবার ভয় পাচ্ছেন, পরিবারের কাছে সংক্রমণ নিয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করছেন। তাঁদের শঙ্কা দূর কার আমাদের অন্যতম কাজ।
আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই রয়েছে। ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টা আমরা দেখছি।
আইসি এমআর স্বাস্থ্যকর্মীদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেবার কথা বলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সঙ্গে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এর ভিত্তি কী?
আমেরিকার এফডিএ এ দুটি ওষুধ অসুস্থদের আপৎকালীন চিকিৎসায় ব্যবহার করতে বলেছে।
আমরা এর কথা অনেক আগেই বলেছি। আমরা ল্যাবরেটরি পরিসংখ্যান ও ফ্রান্স এবং চিনের কিছু পরিসংখ্যান দেখেছি।
বেশি তাপমাত্রায় এ ভাইরাস ক্রিয়াশীল থাকে না বলে রিপোর্ট।
যে কথাটা উঠেছে তা হল তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাস বেশিদিন দীর্ঘক্ষণ বাঁচে না। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি হলে খোলা জায়গায় সম্ভবত এ ভাইরাস দীর্ঘক্ষণ বাঁচবে না।
কিন্তু এ কথা বলা হলেও মনে রাখতে হবে সিঙ্গাপুর ও আরও গ্রীষ্মপ্রধান জায়গায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে। এবং আমাদের অনেকেই বাড়ির বাইরে দীর্ঘক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জায়গায় অতিবাহিত করি। সেখানে যদি আমাদের সর্দি কাশি হয় তাহলে সে পরিবেশে ভাইরাস দীর্ঘক্ষণ কার্যকর থাকবে।
শপিং মল বা অফিসে এরকম হতে পারে। ফলে সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ফলে গ্রীষ্মকাল বাইরে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারলেও ঘরের ভিতর বোধহয় পারবে না।