Magnet Man Vaccination: কোনও কোনও খবর দেখে চোখের মাথা খারাপ হয়ে যায়! আরে এমন হয় নাকি? ছিল মানুষ, হয়ে গেল মানুষ-চুম্বক। করোনার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড নেওয়ার পরই এমন রূপান্তর। দাবি শিলিগুড়ির ভক্তিনগরের ৫৮ বছর বয়সি নেপাল চক্রবর্তীর। দিন দুই আগে নাসিকের শিবাজি চকের ৭০ বছরের অরবিন্দ জগন্নাথ সোনার ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার পর নাকি মানব-চুম্বক হয়েছেন। অরবিন্দের চুম্বক-শরীরের খবর দেখতে দেখতে ভ্যাকসিন-নেওয়া নেপাল কৌতূহলী হয়ে নিজের গায়ে লোহার জিনিসপত্র ছুঁইয়ে পরীক্ষা করেন, হ্যাঁ, তিনিও তো… নয়া চুম্বক দেহের জন্ম হয়! নাহ, এঁদের শরীরে অন্য কোনও সমস্যা নেই। শুধু চুম্বক-জ্বালায় যা জ্বলছেন!
ভ্যাকসিনের এই নব-সাইড এফেক্টের আবির্ভাব দেখে বিজ্ঞানীরা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ট্রায়ালপর্বে তো বহু জনকে কোভিশিল্ড দেওয়া হয়েছিল, তখন এমন ম্যাগনেট বডির এতটুকুও মেঘ ঘনায়নি কোথাও, তা হলে কোথা থেকে এই এফেক্টের আমদানি হল?
এর আগেও বহু ম্যাগনেট ম্যান
ম্যাগনেট ম্যান অবতার হিসেবে পৃথিবীতে জগন্নাথ, নেপালদের প্রথম আবির্ভাব ঘটেনি। কোভিড যুগের আগে এমনটা ভূরিভূরি হয়েছে। এ নিয়ে উইকিপিডিয়ায় একটি পেজও রয়েছে। নাম হিউম্যান ম্যাগনেটিজম। সেখানে বলা হচ্ছে, শুধু লোহা বা লোহা জাতীয় পদার্থ নয়-- গ্লাস, পোর্সেলিন, কাঠ, প্লাস্টিকও কারও কারও ত্বক টেনে ধরেছে। হিউম্যান ম্যাগনেট হিসেবে দাবিদারদের একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে ওই পেজে। যেমন, রোমানিয়ার আউরেল রেইলেয়ানু, যিনি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী হিউম্যান ম্যাগনেট হিসেবে দাবি করেন। ক্রোয়েশিয়ার একটি বাচ্চা ছেলে ইভান স্টোইলজকোভিচও হয়ে ওঠে চুম্বক মানব। জর্জিয়ার এটিবার এলচিয়েভ। যাঁর শরীরে সবচেয়ে বেশি চামচ আটকানোয় নাম ওঠে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। প্রাক্তন বক্সার এবং ম্যারাথন রেকর্ড করা জন গ্রিনউড দাবি করেন, তাঁর চার দিকে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়, যা নাকি ঘড়ি পর্যন্ত থামিয়ে দিতে পারে। এর পর ইউটিউবে গিয়ে যদি একটু 'ম্যাগনেটিক ম্যান' সার্চ করেন, তা হলে ভেসে উঠবে একধিক শরীরের ছবি, যে সবে চামচ থেকে হাতুড়ি-- কত কী না আটকে।
আরও পড়ুন, এক শরীরে দুই বা তার বেশি ভ্যাকসিন কি সম্ভব?
সত্যি না মিথ্যা?
নাম-করা মার্কিন সংশয়বাদী (Skeptic) ও লেখক বেঞ্জামিন রেডফোর্ড এক স্বঘোষিত ম্যাগনেটিক ম্যানের শরীরে কম্পাস দিয়ে পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, কোনও প্রভাবই পড়েনি কম্পাসযন্ত্রে। পাশাপাশি, এমন আরও কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন রেডফোর্ড, যা মানব ম্যাগনেটের দাবির বুদবুদ ফাটিয়ে দেবে। যদিও বিজ্ঞানে শেষ বলে কিছু নেই, তাই দেহে লোহা আটকানোর এই সব ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চয় আরও তলিয়ে দেখবেন। কোভিশিল্ডের সাইড এফেক্টের সঙ্গে এর কোনও সুদূর সম্পর্ক আছে কিনা, তারও চুলচেড়া বিশ্লেষণ হবে বৈকি!
সাইড এফেক্টের অআকখ
প্রাথমিক ভাবে কোভিড ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্ট হিসেবে সামনে এসেছে মাথা-ধরা, ক্লান্তি, জ্বর। যেগুলিকে দেহের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। ফলে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের প্রতিষেধক বিভাগের প্রধান পিটার মার্কস বলছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর দিন বেশি কাজকম্ম করার পরিকল্পনা করা উচিত নয়। কারণ, শরীর আপনার সঙ্গ নাও দিতে পারে।
আরও পড়ুন, বর্ষায় বাড়ছে লেপ্টোস্পাইরোসিস দাপট, কেন হয় এই রোগ?
কেন জ্বর, গা-ব্যথা?
ভ্যাকসিন প্রবেশের পর শরীরের প্রতিরোধ শক্তি ওই অনুপ্রবেশকারীকে ধরে ফেলে। শ্বেত কণিকারা যথাস্থানে হাজির হয়ে যায়, লড়াই শুরু হয়, তাতেই ওই জ্বর, গা-ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এও হতে পারে প্রতিরোধ শক্তি কম বয়সীদের বেশি, তাই ওই সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তাদের শরীরে বেশি দাঁতনখ বার করছে। আবার, দেখা গিয়েছে, একটি ভ্যাকসিনের তুলনায় আরেকটির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম বা বেশি। দেখা যাচ্ছে, এক-এক জনের ক্ষেত্রে এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এক-এক রকম। প্রতিষেধক নেওয়ার পর কারওর কোনও সাইড এফেক্ট হয়নি মানে এও নয় যে, তাঁর শরীরে ভ্যাকসিন কাজের কাজটা করবে না।
আরও একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ভ্যাকসিনের পর বগলে থাকা লিম্ফ নোডগুলি ফুলে উঠতে দেখা গিয়েছে কয়েকটি ক্ষেত্রে। লিম্ফ নোড কী এখানে ঝলকে বলে নিই। গলা, বগল, ঘাড়, পেট, কুঁচকিতে থাকা এক ধরনের গ্রন্থিকে লিম্ফ নোড বলে। বাংলায় বলে লসিকা গ্রন্থি। রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এই গ্রন্থি। কোভিড ভ্যাকসিনের পর যদি লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে, তা হলে চিন্তার কিছু নেই, কারণ এটা একেবারে সাময়িক। অবশ্য মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক নেওয়ার আগে ম্যামোগ্রাম (স্তনের এক্স-রে) করিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়ে বুকের কাছাকাছি থাকা লিল্ফ নোডগুলি ফুলে ওঠে। আর, ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে কিনা বোঝার জন্য প্রাথমিক পরীক্ষা ম্যামোগ্রাম-- ফলে ওই এক্স-রে করিয়ে নিলে ভ্যাকসিনের পর লিম্ফ নোড ফুলে উঠলেও চিন্তার কিছু থাকছে না। কিন্তু ভারতের মতো দেশে বুকের ম্যামোগ্রাম করিয়ে তার পর ভ্যাকসিন নেওয়ার চিন্তা করাটা আকাশকুসুম। তা ছড়া ভ্যাকসিনের পর লিম্ফ নোড ফুলে ওঠার সংখ্যাটাও সামান্য।
আরও পড়ুন, কপালজোর! তিমির পেটে গিয়েও প্রাণে বাঁচলেন ডুবুরি
রক্ত জমার বাঁধা
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধা বা ব্লাড ক্লটের খপ্পরে পড়েছেন হাতে গোনা কয়েক জন। বিশেষ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন নিয়ে। এই ব্লাড ক্লটের ধরনটা একটু অন্য রকম, মানে আনইউজুয়াল টাইপের। আবার, কারওর কারওর ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অ্যালার্জির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। মার্কিন মুলুকে ফাইজার ও মর্ডানার মতো এমআরএনএ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর গুটিকয় ক্ষেত্রে হার্টে সাময়িক সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে খবর। এঁরা প্রায় সকলেই তরুণতরুণী। নজর রাখা হয়েছে এঁদের উপর, এখনও কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি আমেরিকার স্বাস্থ্য বিভাগ।
ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে শরীর চুম্বক হয়ে যওয়াটা এ সবের মধ্যে অনেকটা ফেয়ারি টেলের মতো। এই টেল থুড়ি খবরটা ফেয়ার না আনফেয়ার? ম্যাগনেট ম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ে কি ভ্যাকসিন হেরে যাবে? উত্তরের এখনও বাকি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন