বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া গভীর নিম্নচাপ ‘বুলবুল’ প্রবল আকার ধারণ করেছে। আগামী ৫ থেকে ৬ ঘন্টায় যা তীব্রতর হবে। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়। ফলে, রাজ্যের উপকূলীয় অংশে ভারী বৃষ্টির সঙ্গেই বইবে ঝোড়ো হাওয়া। হাওয়ার সম্ভাব্য তীব্রতার কথা মাথায় রেখে লাল সতর্কতা জারি করেছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর, যা আগে ছিল 'হলুদ' সতর্কতা।
হলুদ সতর্কতার অর্থ, গুরুতর রকমের খারাপ আবহাওয়া আশা করতে পারেন। কোথাও সফর করার থাকলে, অথবা দৈনন্দিন কাজেও, ব্যাঘাত ঘটাতে পারে আবহাওয়া, অতএব নেহাত জরুরি না হলে দূরপাল্লার সফর স্থগিত রাখাই ভালো। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতে থাকা পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে হাওয়া অফিস, এবং জনগণের উদ্দেশে বার্তা হলো, নজর রাখুন আপনারাও, কারণ যে কোনও সময় অবস্থার অবনতি হতে পারে।
লাল সতর্কতা তারও দুই ধাপ ওপরে, অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়ার ইঙ্গিত। সাধারণভাবে এর অর্থ হলো, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দাদের উচিত, এই মুহূর্তে নিজেদের এবং অন্যান্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। ব্যাপক হারে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা, বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত, এবং স্বাভাবিক চলাফেরায় ব্যাঘাতের সম্ভাবনা।
আবহাওয়া বিজ্ঞানের পরিভাষায়, 'সাইক্লোন বুলবুল' বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে 'ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম' আখ্যা পেয়েছে। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূলের আরও কাছাকাছি আসবে সে। তা এহেন ভয়ঙ্কর ঝড়ের এমন ফুরফুরে নাম কেন? আবহাওয়াবিদরা কি ইয়ার্কি করছেন আমাদের সঙ্গে? তা ঠিক নয়, তবে এখানে ব্যঙ্গের একটা ভূমিকা রয়েছে বটে। যেমন এই ফুরফুরে নামকরণ করেছেন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদরা।
কীভাবে হলো এই নাম রাখা? বুলবুলের পাশাপাশি গুজরাট উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে 'সাইক্লোন মাহা'। তার আগে 'ফণী', অথবা 'বায়ু', অথবা 'তিতলি', আমাদের সকলেরই ভালোরকম মনে আছে। এখন কথা হচ্ছে, এইসব নাম কে বা কারা রাখে? উত্তর হলো, বিভিন্ন দেশ।
বহু বছর আগেই স্থির করা হয়, সংখ্যা বা পরিভাষার চেয়ে যেহেতু নাম মনে রাখা সহজ, সেহেতু নামকরণ করা হবে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের (tropical cyclone)। এতে যেমন জন সচেতনতা বাড়াতে সুবিধে হয়, তেমনই মিডিয়ার সুবিধে হয় ঝড় নিয়ে লিখতে।
তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, এই প্রথা প্রথম চালু হয় অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে। যেসব ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৯ মাইল ছাড়িয়ে যেত, তাদের বিশেষ সম্মান জানাতে নামকরণ করা হতো। ঘণ্টায় হাওয়ার গতিবেগ ৭৪ মাইল ছাড়িয়ে গেলে হারিকেন, সাইক্লোন, বা টাইফুন হিসেবে ভাগ করা হতো। বর্তমান যুগে এই তিনটির একটি হলে তবেই কোনও ঝড়কে নামকরণের সম্মান প্রদান করা হয়।
আজকের দিনে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের আনুষ্ঠানিক নামকরণ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের আওতায় এগারোটি সতর্কতা কেন্দ্রের যে কোনও একটি। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সব নাম জমা পড়ে এই সংস্থার আঞ্চলিক ট্রপিক্যাল সাইক্লোন কমিটির কাছে। একবার নাম চূড়ান্ত হয়ে গেলে তা বদল করা যায় না, যদি না ঝড়ের ফলে খুব বেশি মাত্রায় মৃত্যু অথবা সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। যেমন ধরুন, 'ফণী' নামটা কে রেখেছিল? উত্তর: বাংলাদেশ। এই নামকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে দিল্লির রিজিওনাল স্পেশালাইজড মিটিওরোলজিকাল কেন্দ্র।
ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশন একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে যার দ্বারা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নামের তালিকা গ্রহণ করে তারা। প্রয়োজন মতো এই সমস্ত তালিকা থেকে বেছে নেওয়া হয় নাম। ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ভূত ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের নামের তালিকা আঞ্চলিক কমিটির কাছে পাঠায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, এবং থাইল্যান্ড।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই আটটি দেশের তরফে আটটি করে ভবিষ্যতের সাইক্লোনের নাম জমা করা হয়েছে। সেই ৬৪ টি নামের তালিকা থেকেই বেছে নেওয়া হয় 'ফণী', 'তিতলি', বা 'আইলা'। বর্তমানে এই তালিকার শেষ স্তম্ভ থেকে নাম বাছা হচ্ছে, ফলে এই অঞ্চলে পরবর্তী সাইক্লোনের নাম হতে চলেছে 'পবন', সৌজন্যে শ্রীলঙ্কা।
উল্লেখ্য, ২০১৯-এর মরসুম ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের নিরিখে সবচেয়ে সক্রিয় মরসুমগুলির একটি। ইতিমধ্যেই সাতটি ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে এই অঞ্চল দিয়ে, যার মধ্যে নজিরবিহীন ভাবে ছ'টি 'ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্মের' সম্মান অর্জন করেছে। সপ্তম ঝড়টি ছিল 'কিয়ার', যাকে 'সুপার সাইক্লোনিক স্টর্ম' আখ্যা দেওয়া হয়।