চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফুকে গত দুই সপ্তাহে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। যার ফলে চিনের সেনাবাহিনী এবং সেদেশের অভ্যন্তরে চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অপসারণ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এমনটাই রিপোর্টে জানিয়েছে সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গ। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯ সেপ্টেম্বর চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উত্তর চিনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে সফরের সময় 'সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চস্তরের অখণ্ডতা ও ঐক্য বজায় রাখার এবং সামরিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও সুরক্ষিত থাকার' কথা বলেছেন। এমনটা জানিয়েছে চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া। আর, জিনপিঙের ওই মন্তব্যের জেরে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অপসারণ সম্পর্কে জল্পনা বেড়েছে বলেই দাবি ব্লুমবার্গের।
জল্পনা আরও জোরালো
জাপানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রহম ইমানুয়েলের মন্তব্যের পর সেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে। তিনি ৮ সেপ্টেম্বর সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ বলেছেন, 'প্রেসিডেন্ট শির মন্ত্রিসভা এখন আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কারণ, শি-এর পরে যেন কেউ নেই। প্রথমে, বিদেশমন্ত্রী কিন গ্যাং নিখোঁজ হয়েছিলেন। তারপরে রকেট ফোর্সের কমান্ডাররা নিখোঁজ হন। এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লি শাংফুকে দুই সপ্তাহ ধরে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। এই বেকারত্বের দৌড়ে কে জিতবে? চিনের যুবসমাজ নাকি শির মন্ত্রিসভা? বেজিঙের ভবনে রহস্য।'
প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু
লি শাংফু ১৯৮২ সালের আগস্টে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)-তে যোগদান করেন এবং ডক্টর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য, শীর্ষ নেতাদের অন্যতম। দ্য ডিপ্লোম্যাটের একটি প্রবন্ধ অনুসারে, যখন ২০২৩ সালের মার্চ মাসে লিকে মন্ত্রী করা হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, তখন তাঁর বাবা চিনের সেনাবাহিনী পিএলএর রেলওয়ে ফোর্সের জেনারেল ছিলেন। ওই প্রবন্ধ অনুযায়ী, 'লি মহাকাশ অভিযানের অভিজ্ঞতায় অনন্য।' চিনের রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার জন্য লি শাংফু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাতেও পড়েছিলেন। ব্লুমবার্গ তার প্রতিবেদনে বলেছে যে লি শাংফুকে শেষবার জনসাধারণের সামনে ২৯ আগস্ট দেখা গিয়েছিল। সেই সময় তিনি বেজিংয়ে ৩য় চিন-আফ্রিকা শান্তি ও নিরাপত্তার মঞ্চে একটি মূল বক্তব্য রেখেছিলেন।
চিনে কী ঘটেছে?
ইমানুয়েলের পোস্টে ইঙ্গিত করা হয়েছে, চিনে এর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মতই লি-র অন্তর্ধানের বিষয়টি। সেটা বোঝাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিন গ্যাংয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন কিন গ্যাং। ২০২৩ সালের ২৫ জুন থেকে শুরু করে প্রায় একমাস তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। কিন আন্তর্জাতিক মিটিং এবং সফরগুলোতেও অংশগ্রহণ করেননি। আর, ২৫ জুলাই তিনি নতুন মন্ত্রী হিসেবে ওয়াং ইয়ের স্থলাভিষিক্ত হন। যদিও এই বদলি সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য দেয়নি বেজিং। জানায়নি কেন রদবদল করা হল। কিন্তু, তারপর থেকে কিনকে আবার দেখা যাচ্ছে না। অথচ, এই সবের আগে কিন প্রেসিডেন্ট শির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। যে কারণে তাঁর কেরিয়ারে দ্রুত উত্থান ঘটছে বলেও মনে করা হচ্ছিল।
জেনারেল দ্বিবেদীর চোখে
চিনে, দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান (আনুষ্ঠানিকভাবে, চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক), চিনের সামরিক বাহিনীর প্রধান (বা কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং প্রধান। এই প্রসঙ্গে ভারতের মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক জিজি দ্বিবেদী ২০২০ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লিখেছেন, 'একটি জাতির জন্য একটি সেনাবাহিনী থাকাই প্রথা। কিন্তু, একটি রাজনৈতিক দলের সেনাবাহিনী থাকা, অত্যন্ত বিরল ঘটনা। চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) একটি ব্যতিক্রম। কারণ, এর আনুগত্য চিনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্রতি।'
আরও পড়ুন- ভারী বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি! ‘জাতীয় বিপর্যয়’ ঘোষণার অনুরোধ হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রীর, লাভটা কী?
রকেট ফোর্স কমান্ডাররা
গত ২১ জুলাই শি জিনপিং আনুষ্ঠানিক দুই রকেট ফোর্স কমান্ডারের পদোন্নতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই বাহিনী চিনের সেনার স্থলভিত্তিক পরমাণু অস্ত্রবাহী এবং প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দায়িত্বে আছে। দুই কমান্ডার ওয়াং হাউবিন এবং রাজনৈতিক কমিসার জু জিশেংকে জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়েছিল। যা চিনে সরকারি চাকরিতে আধিকারিকদের জন্য সর্বোচ্চ পদ। তবে বাহিনীর ঠিক পূর্ববর্তী কমান্ডার- জেনারেল লিউ গুয়াংবিন এবং জেনারেল লি ইউচানোর সম্পর্কে কিছুই জানায়নি চিনের প্রশাসন। এক সপ্তাহ পরে, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট রিপোর্টে জানায়, যে তাঁদের অপসারণ করা হয়েছে। যা, একটি নতুন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ। প্রতিবেদনে যোগ করা হয়েছে, 'চিনের ওপর পরমাণু অস্ত্রহামলা রুখতে এই বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, তাইওয়ানের ওপর সামরিক চাপ বাড়াতেও বেজিংয়ের কাছে রকেট বাহিনী এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।'