দিল্লি সরকারের দাবি, জোড়-বিজোড় গাড়ির নীতি দূষণের মাত্রা কমায়। যদিও বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এই ব্যাপারে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই। যেটুকু তথ্য আছে, তাতেও ধারাবাহিকতার অভাব আছে। ফলে, সরকারের এই জোড়-বিজোড় গাড়ির নীতি দূষণ বা স্বাস্থ্যে আদৌ কতটা প্রভাব ফেলছে, তা পরিষ্কার না। আর, এই কারণেই দিল্লি সরকারের জোড়-বিজোড় গাড়ি নীতি স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের কুপ্রভাব মোকাবিলার পক্ষে যথেষ্ট বলতে পারছেন না গবেষকরা। দিল্লি আইআইটির অধ্যাপক তথা সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের কোঅর্ডিনেটর ড. সাগ্নিক দে-র মতে, 'ব্যান্ড-এইড যতটা উপকারী, এটাতে সেটুকুও উপকার হয় না।'
আইআইটির অধ্যাপক কী বলছেন?
জোড়-বিজোড় নীতি কেন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. সাগ্নিক দে। তিনি বলেন, 'জোড়-বিজোড় নীতি চালু হলেই যে রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা ৫০% কমে যাবে, তেমনটা কিন্তু না। আরও বড় ব্যাপার হল, কার্বনের নির্গমন কমা মানেই বাতাসে দূষণের ঘনত্ব কমে যাওয়া না। কারণ, এটি বায়ুর গতির মতো আবহাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেই কারণে, এখনও পর্যন্ত জোড়-বিজোড় নীতির জেরে একইরকম প্রভাব সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়নি। কিছু এলাকায় দূষণ কমেছে। কিছু জায়গায় হয়নি। অথবা দেখা গেছে, দূষণ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কমেছে।' ড. দে এই ব্যাপারে বলেন যে, বায়ুদূষণের মাত্রার এই সামান্য কমে যাওয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর আদৌ কোনও প্রভাব ফেলে কি না, তা নিয়ে কোনও গবেষণা হয়নি।
এইমসের অধ্যাপক কী বলছেন?
দিল্লি এইমসের পালমোনারি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের অতিরিক্ত অধ্যাপক ডা. করণ মদন বলেন, 'যখন পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার) বা বস্তুকণার ঘনত্ব ২.৫ থাকে, আর এর মাত্রা ৫০০-র বেশি হয়, তখন তা ২০% কমে গেলেও দূষণের মাত্রা খুব একটা কমে না। মাত্র ৪০০-য় এসে ঠেকে। দিল্লির দূষণের পরিস্থিতি তাই এখনও বেশ ক্ষতিকারক। দূষণের দীর্ঘমেয়াদি ফলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মত কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ে। পাশাপাশি, ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার, রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যাওয়া, বিষণ্ণতার ঝুঁকিও বাড়ায়।'
গবেষণা কী বলছে?
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে দিল্লিতে জোড়-বিজোড় প্রকল্প কার্যকর হলে দূষিত কণার মাত্রা কমে যায়। কিন্তু, এই হ্রাস মাত্র ৫ থেকে ১০% ঘটে। আইআইটি দিল্লির ড. দে এবং আইআইটি কানপুরের ড. এসএন ত্রিপাঠি উপগ্রহ ডেটা ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে ২০১৬ সালে জোড়-বিজোড় নীতির বাস্তবায়নের ফল। তাতে দেখা গিয়েছে, দিল্লির বেশিরভাগ অংশে বায়ুর বস্তুকণার ঘনত্বের মাত্রা ২.৫। দূষণ হ্রাস পেয়েছে তার মাত্র ২ থেকে ৩%। তিনটি জায়গায় কেবল হ্রাস পেয়েছে ৮ থেকে ১০%। এব্যাপারে দিল্লি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বস্তুকণার ঘনত্ব ২.৫ থাকার সময় দূষণের মাত্রা কমেছে গড়ে ৫.৭৩% এবং বস্তুকণার ঘনত্ব যেখান ১ মাত্রায় রয়েছে, সেখানে দূষণের মাত্রা কমেছে ৪.৭০%। গবেষণায় দেখা গেছে, কম গাড়ির কারণে এবং কম যানজটপূর্ণ রাস্তায় যানবাহন দ্রুত চলার কারণে এবং ইঞ্জিন টানা চললেও বাতাসে কার্বন বেড়েছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে কমেছে দুপুরে, সকালে নয়। কারণ, সকালের ঠান্ডা তাপমাত্রা দূষিত পদার্থকে মাটির কাছাকাছি টেনে রাখে। আইআইটি দিল্লি এবং ব্রিটেনের দুটি কলেজের গবেষকরা আরেকটি সমীক্ষায় ২০১৬ সালের দূষণের স্তরের সঙ্গে তার আগের বছরের দূষণের তুলনা টেনেছেন। যে সময় এই তুলনা টানা হয়েছে, সেই সময় দিল্লিতে জোড়-বিজোড় নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে যে বস্তুকণার ঘনত্ব ২.৫ থাকাকালীন আগের বছরের জোড়-বিজোড় প্রকল্প চালু থাকা সময়ের চেয়ে তা -২ থেকে -৪৪% শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু, জোড়-বিজোড় চালু না-থাকা সময়ের চেয়ে তা বেড়েছে ২-১২৭%।
কেন NO2 হ্রাস দরকারি?
জোড়-বিজোড় প্রকল্প থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। ড. দে বলেছেন, রাস্তায় কম যানবাহন এবং কম যানজটের কারণে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের (NO2 ) মত বায়ু দূষণকারী পদার্থের নির্গমন কমে যায়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এইমসের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাতাসে বস্তুকরণার ঘনত্ব ২.৫ থাকার চেয়েও NO2-এর মাত্রা বৃদ্ধির ফলেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। কতটা? সেই সমীক্ষা বলছে, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের স্বল্পমেয়াদি বৃদ্ধির এক সপ্তাহ পরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগীর সংখ্যা ৫৩% বেড়েছে।
আরও পড়ুন- কুষ্টিয়ায় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর অসামান্য বীরত্ব, ‘পিপ্পা’-য় গরিবপুরের লড়াইয়েরও স্মৃতিতর্পণ
তাহলে কী করতে হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেটাই করতে হবে, তা দীপাবলির পরেই শুরু করা উচিত। কারণ, কোনও ব্যবস্থাই পটকার তৈরি দূষণ থেকে বাঁচাতে পারবে না। চিকিৎসকরা ইতিমধ্যেই পটকা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি পথ দেখাতে গিয়ে ড. সাগ্নিক দে বলেছেন, BS-IV যানবাহনকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। আরও বৈদ্যুতিক যানবাহন চালু করার মতো পদক্ষেপ বাড়াতে হবে। জোড়-বিজোড়ের মত ব্যবস্থা শুধু দিল্লিতেই নয়। গোটা উত্তরাঞ্চলে প্রয়োগ করা উচিত। এর পাশাপাশি ডা. করণ মদন, স্কুলে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন।