কোভিডকে আটকাতে ভাবনাচিন্তার কোনও শেষ নেই গবেষক-ডাক্তারদের। ভ্যকসিন এসেছে বহু কষ্টে, তবে ওষুধের জন্য চলছে হাপিত্যেশ অপেক্ষা। কয়েকটি পুরনো ওষুধকে বেশ কিছু দিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে করোনার চিকিৎসায়। তার মধ্যে একটি-- স্টেরয়েড। করোনা সংক্রমিত কোষ থেকে অনেক সময় বাড়াবাড়ি মাত্রায় সাইটোকাইন নিঃসরিত হয়, তা আটকানোর চেষ্টা করে এই স্টেরয়েড। এর প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, স্টেরয়েডের বেলাগাম ব্যবহার হচ্ছে, অনেক সময়ে এর পরিণতি হচ্ছে ভয়ঙ্কর। এই অবস্থায় আর একটি পুরনো ও পোড়-খাওয়া ওষুধ করোনায় কাজে আসতে পারে বলে গবেষণায় সামনে এল। সেই ওষুধটির নাম মেটফরমিন। শুনে অনেকে রে-রে করে উঠতে পারেন। আরে এটা যে ব্লাডসুগারের ওষুধ, করোনায় আবার এর কী কাজ? মশায় কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই। নাহ… ভুল নয়, টাইপ টু ডায়াবিটিসের প্রথম পর্যায়ে বহুল ব্যবহার হওয়া সেই আদি অকৃত্রিম মেটফরমিনের কথাই বলা হচ্ছে। এটিই ল্যাবরেটরিতে করোনার বিরুদ্ধে কামাল দেখিয়েছে।
মেটফরমিনের কাজ কী?
মেটফরমিন লিভারে গ্রুকোজ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। রক্তে চিনির মাত্রা কমে। এর ফলে দেহ ইনসুলিনে আরও বেশি সাড়া দিতে থাকে। এছাড়াও আর একটি কাজ করে এই ওষুধ। এর রয়েছে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ কমানোর ক্ষমতা। মানে, ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার হামলায় প্রতিরোধ শক্তির পাল্টা লড়াইয়ে যে ক্ষত বা অসুস্থতা তৈরি হয়, তা কমানোর ক্ষমতা। আর এই গুণে লুকিয়ে কোভিডে মোটফরমিনের কাজ করার কারণ।
মেটফরমিনে ম্যাজিক?
৮ জুন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয় ইমিউনিটি অনলাইন জার্নালে, তাতে এই ওষুধের কোভিড প্রতিরোধী শক্তির অমৃতসমান কথা লেখা হয়েছে। পরীক্ষাটি হয় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো-র গবেষকদের নেতৃত্বে। মেটফরমিন প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে আক্রান্ত ইঁদুরের উপর। তাতে সাফল্য এসেছে।
কেন মেটফরমিন বাছা হল?
আচ্ছা, কী ভাবে এই ওষুধটি কোভিডে লাগাম দিতে পারে বলে মনে করলেন বিজ্ঞানীরা? প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেশ কিছু দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, কোভিডে আক্রান্ত ডায়াবিটিস রোগীদের যাঁরা মেটাফরমিন নিয়েছেন, তাঁদের মৃত্যু কম হয়েছে। আবার মেটফরমিন ওবেসিটিরও ওষুধ। ওই একই ঘটনা ঘটেছে ওবেসিটির ক্ষেত্রেও। অথচ ডায়াবিটিস ও ওবেসিটি করোনার দুটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। এতে কো-মর্বিডিটির মহাচক্রে করোনা আক্রান্তের প্রাণ যাওয়াটা আকছার ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু মেটফরমিন খেলার ফলাফল বদলে দিচ্ছে। কী করে ফলাফল বোঝা গেল? গত বছরের ডিসেম্বরের ৩ তারিখ দ্য ল্যানসেট হেলদি লংজিবিটি জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ বেরোয়। মেটফরমিন নিতেন না এমন ৩ হাজার ৯২৩ জন কোভিড রোগী, এবং ২ হাজার ৩৩৩ জন, যাঁরা মেটফরমিন নিতেন, তাঁদের রিপোর্ট খতিয়ে দেখেন ক্যারোলিন টি ব্রামান্টে এবং আরও কয়েক জন গবেষক। তাতেই দেখা যায় মেটফরমিন খাওয়া রোগীদের মৃত্যু কম হয়েছে। দ্য ল্যানসেট হেলদি লংজিবিটি জার্নালের ওই প্রবন্ধে এই গবেষক দল আবার এমনও জানান: বিশ্লেষণে স্পষ্ট মেটফরমিন খাওয়া কোভিড আক্রান্ত মেয়েদের মৃত্যুর হার ছেলেদের তুলনায় চোখে পড়ার মতোই কম।
ইঁদুর পরীক্ষায় উঁকি
এবার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো স্কুলের গবেষকদের নেতৃত্বাধীন দল ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় নামলেন। করোনা হলে অনেকের প্রবল শ্বাসকষ্ট বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম বা এআরডিএস হয়। সেই অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোমে আক্রান্ত ইঁদুরের উপর মেটফরমিনের পরীক্ষা করলেন তাঁরা। তার পর যেন নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেন গণেশের বাহনের দিকে। দেখা গেল, হ্যাঁ, মেটফরমিন দেওয়ায় ইঁদুরের শরীরে এআরডিএসের দাপট কমেছে।
এই ঘটনার কারণ কী?
ইমিউন অলাইন জার্নালের ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ইঁদুরের ব্যাক্টেরিয়াল নিউমোনিয়া (ব্যাক্টেরিয়া থেকে যে নিউমোনিয়া হয়) কমিয়েছে মেটফরমিন। কমেছে আইএল-ওয়ান বিটার মতো প্রোটিনের নিঃসরণও। আইএল-ওয়ান বিটা কী বস্তু? আইএল-ওয়ান বিটা, আইএল-সিক্স এরা হল সাইটোকাইন। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ঢুকলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম যুদ্ধে নামে। তাতেই কোষ থেকে সাইটোকাইন বেরিয়ে আসতে থাকে। এরা প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার অংশ এবং আক্রান্ত কোষের আশপাশের কোষগুলিকে শরীরে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি আক্রমণের সতর্কবার্তা দেয়। কিন্তু সার্স কোভ-টু সংক্রমণে রোগীদের একাংশের দেহ-কোষগুলি থেকে সাইটোকাইন এত বেশি বের হতে থাকে যে তৈরি হয় সমস্যা। যাকে সাইটোকাইন ঝড় বলা হয়। এর অর্থ, কোনও রোগীর প্রতিরোধ ব্যবস্থাই তাঁর শরীরের কোষ ও টিস্যুগুলির উপর হামলা চালাতে শুরু করে। মানে শত্রুর বদলে নিজের দলের উপর তোপ দাগতে থাকে তারা, শরীর নাজেহাল হতে থাকে এর ফলে। এখন এই সাইটোকাইন আইএল-ওয়ান বিটা নিঃসরণ একটি জটিল প্রোটিন যৌগ ইনফ্ল্যামাসামের উপর নির্ভর করে। যাদের ভাল সংখ্যক উপস্থিতি ফুসফুসের টিস্যুতে। মৃত কোভিড রোগীদের ফুসফুসের টিস্যু বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে এই যৌগের জন্য তাঁদের টিস্যুগুলি অনেকটা ফুলে গিয়েছিল। প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণটাই হয় এই। এখন ইঁদুর-পরীক্ষায় দেখা গেল এই ফোলাটা কমাচ্ছে মেটফরমিন। যদিও কোভিডের চিকিৎসায় ব্যবহারে আগে এই ওষুধের বিস্তারিত ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রয়োজন রয়েছে। মেটফরমিনের দাম বেশ কম, যদি করোনায় এর ব্যবহারের ছাড়পত্র মেলে, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই রোগীদের অত্যন্ত সুবিধা হবে। করোনা কত পরিবর্তন আনছে। কত কিছুর নতুন নতুন চরিত্র এসে যাচ্ছে সামনে। আমরা তো নতুন একটা পৃথিবীতে বাস করছি এখন। মেটফরমিন ওষুধের নতুন ক্ষমতার পাথুরে প্রমাণ, সেই পৃথিবীরই একটা ঘর।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন