দেবী লক্ষ্মী- সম্পদ, সমৃদ্ধি আর সৌভাগ্যের দেবী। তিনি দীপাবলিতে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা। সেই কারণে, দীপাবলিতে গোটা দেশে চলে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। দেবী লক্ষ্মীর এক রূপ হল, তিনি পদ্মের ওপর নিশ্চিন্তে বিশ্রামরত। আরেকটি রূপ হল, তিনি হাতির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। দেবীর বিভিন্ন রূপের বিভিন্ন নাম আছে। বছরের পর বছর ধরে মূর্তিনির্মাণ বিদ্যায় এই সব রূপ ব্যবহৃত হয়। শিল্পীরা দেবীকে নানারূপে কল্পনা করেছেন। কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী লক্ষ্মীকে এই সব বিভিন্ন রূপেই আরাধনা করা হচ্ছে।
শাস্ত্রে দেবী লক্ষ্মী
হিন্দু শাস্ত্রে দেবী লক্ষ্মীকে 'সৌভাগ্যের প্রতীক' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা ঋগ্বেদের যুগে। অথর্ব বেদের সময় দেবীকে শ্রী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ এএল বাশামের, 'দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া'য় দেবীকে 'সৌভাগ্য এবং আশীর্বাদের দেবী' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর, কিংবদন্তিতে তিনি 'বিষ্ণুর সঙ্গে অবস্থান' করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেবী সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে এসেছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে দেবীকে সুন্দরী মহিলা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এই সুন্দরী দেবী, একটি পদ্মের ওপর বসে থাকেন। তাঁর হাতে থাকে পদ্ম। পাশে দুটি হাতি থাকে। হাতিগুলো শুঁড় দিয়ে দেবীকে জল ছিটিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন- ঘনঘন ভূমিকম্প, যেন দুলছে আইসল্যান্ড, বড় কোনও বিপদের মুখে পৃথিবী?
দেবীর নানারূপ
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর গান্ধার মুদ্রায় আবার দেখা যায়, দেবী লক্ষ্মী একটি পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। যার পাশে দুটি হাতি। অযোধ্যা, কৌশাম্বী এবং উজ্জয়িনীতে পাওয়া একই সময়ের মুদ্রাগুলি তাঁকে গজলক্ষ্মী হিসেবে চিত্রিত করেছে। মধ্যপ্রদেশের সাঁচি স্তূপে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রতিকৃতিতে দেখা যায়, দেবীর পরনে কুণ্ডল (কানের দুল) এবং গয়না। অন্যান্য জায়গায় দেবীকে পদ্মের ওপর উপবিষ্ট, শক্তি এবং আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ইলোরা গুহায় দেবীকে তাঁর স্বামী বিষ্ণু এবং তাঁর 'বাহন' গরুড়ের সঙ্গে চিত্রিত করা হয়েছে। গুপ্ত যুগে (খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী) দেবী লক্ষ্মীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হত। তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা এবং 'সিংহবাহিনী'। এই সময়কার এই রূপের অসংখ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।
অষ্টলক্ষ্মীর রূপ
ভারতজুড়ে দেবী লক্ষ্মীকে সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধির মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পদ্মকে বিশুদ্ধতা এবং জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে দেবীর গজলক্ষ্মী রূপের সবচেয়ে বেশি চল আছে। যেখানে তিনি পদ্মের ওপর উপবিষ্ট। দেবীর হাতে ফুল। তাঁর সঙ্গে রয়েছে হাতি। উত্তর ভারতে দেবীর চার হাতের রূপ প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গে, কোজাগরী পূজায় দেখা যায়, দেবীর বাহন তুষারাবৃত এলাকার পেঁচা। পূর্ব ভারতজুড়ে, দেবী লক্ষ্মীর মোট আটটি রূপ প্রচলিত। যা অষ্টলক্ষ্মী নামে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে আদি লক্ষ্মী, যিনি সম্পদের মাধ্যমে মানুষকে তাঁদের লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করেন। বীর লক্ষ্মী, যিনি বীরত্বের প্রতীক। সন্তানলক্ষ্মী, যিনি উর্বরতার প্রতীক। দক্ষিণ ভারতে তাঞ্জোরের পেইন্টিংয়ে প্রায়শই দেবী লক্ষ্মীকে সোনার পালঙ্কে পদ্ম এবং গজ-সহ আসীন হিসেবে দেখানো হয়।
ক্যালেন্ডারে লক্ষ্মীর ছবি
ক্যালেন্ডার শিল্পের আবির্ভাব, ভারতে প্রিন্টিং প্রেসের অগ্রগতি দেবী লক্ষ্মীর ছবির ব্যাপক প্রচারে আরও সহায়তা করেছে। কারণ, পেইন্টিং এবং মূর্তির চেয়ে, বাড়িতে পূজার জন্য দেবীর প্রিন্টেড ছবি কেনা অনেক বেশি সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। রাজা রবি বর্মা (১৮৪৮-১৯০৬)-র আঁকা ছবি থেকে দেবী লক্ষ্মীর ছবির প্রিন্ট বের করা হয়। তাঁর প্রেসটি ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি এঁকে তার প্রিন্ট বের করেছেন। যার মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যায়, দেবী লক্ষ্মী স্রোতের মাঝখানে একটি পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। তার চারপাশে প্রাণীজগৎ এবং পটভূমিতে পাহাড়। এই ছবিতে দেবী একটি ফ্যাকাশে ব্লাউজের সঙ্গে একটি গোলাপি শাড়ি পরেন। দেবী লক্ষ্মীর প্রচলিত রূপে দেবীর দুই পাশের দুটি হাতির পরিবর্তে ভার্মা শুঁড়ে একটি মালা ধরে থাকা শিশু হাতির ছবি এঁকেছিলেন। রবি ভার্মার আঁকা দেবী লক্ষ্মীর চারটি হাতে দেবী পদ্ম ধারণ করেন। তাঁর ছবি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হওয়ার পর, ভার্মার ছবি বিপণন এবং বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে ছিল ভিনোলিয়া সাবান কোম্পানির প্রকাশিত একটি ক্যালেন্ডারও।
সমসাময়িক ভারতীয় শিল্পে দেবী লক্ষ্মী
দেবী লক্ষ্মী কয়েক দশক ধরেই শিল্পীদের আঁকার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছেন। অনেক শিল্পীই তাঁকে এঁকেছেন। ১৯৯০ সালে তাঁর ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে মকবুল ফিদা হোসেন একই চিত্রে গণেশ, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর ছবি এঁকেছিলেন। অন্য একটি ছবিতে হোসেন গণেশকে কোলে নিয়ে লক্ষ্মী বসে আছেন, সেই রূপ এঁকেছিলেন। আবার, এন পুষ্পমালা তাঁর ফটো-পারফরম্যান্স প্রজেক্ট 'নেটিভ উইমেন অফ সাউথ ইন্ডিয়া: ম্যানারস অ্যান্ড কাস্টমস' (২০০০-২০০৪)-এর অংশ হিসেবে, বর্মার জনপ্রিয় লক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি পুনরায় এঁকেছিলেন। যেখানে দেখা গিয়েছে, দেবীর পরনে লাল শাড়ি। এর পাশাপাশি, অতুল দোদিয়া ২০০২ সালে দেবীর মহালক্ষ্মী রূপ এঁকেছিলেন। যা ছিল সামাজিক বার্তাবাহী।