'আই কান্ট ব্রিদ', শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের কাছে এটাই শেষ আর্তি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের। সেই মৃত্যুতেই বিশ্বজুড়ে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নতুনভাবে ভাষা পেল। সেই আঁচ পড়ল বহুজাতিক সংস্থা হিন্দুস্তান ইউনিলিভারেও। 'শ্যামা'দের দীর্ঘদিন ধরে 'ফর্সা' করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি- ব্র্যান্ডের মালিক হিন্দুস্তান ইউনিলিভার মেনে নিলেন তাঁদের 'আনফেয়ার' মনোভাব। বিগত কয়েক দশক ধরে ব্র্যান্ড ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নাম থেকে 'ফেয়ার'-কেই এবার থেকে বাদ দিতে বদ্ধপরিকর বহুজাতিক সংস্থাটি। জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের এমন সিদ্ধান্তে সমাজের বিভিন্ন অংশে তুমুল প্রতিক্রিয়া মিলেছে।
সমস্যা কোথায় ছিল?
ভারতে বর্ণবৈষম্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড। এখানে বর্ণবাদ সবচেয়ে দৃশ্যমান। বিবাহসম্পর্কিত কাগজের বিজ্ঞাপন হোক কিংবা সাইট, "ফর্সা এবং সুন্দরী" কথাটি চোখে পড়বেই। আর এই বিষয়টিকে হাতিয়ার করেই ভারতের মতো নানা রঙের চামড়ার দেশে আসে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্র্যান্ড। তাদের বিজ্ঞাপনে দেখান হয়, একটি 'ফর্সা' মেয়ে বিয়ের জন্য, এয়ারহোস্টেজের চাকরির জন্য ফেয়ারনেস ক্রিম মাখছে। এমনকী এই বিজ্ঞাপনে বাদ পড়ছেন না ডাক্তাররাও।
বলিউডের সিনেমার ক্ষেত্রে যদি বর্ণবৈষম্যের বিষয়টিকে দেখা যায় সেক্ষেত্রে আমরা দেখব যে বাড়ির পরিচারক, গাড়িচালকদের নাম 'কালু' হয়। খুব পরিচিত গান 'হাম কালে হ্যায় তো ক্যায়া হুয়া দিলওয়ালে হ্যায়' গানের কথাতেই ফুটে উঠছে সমাজের বর্ণবিদ্বেষের নগ্নরূপ। আর গায়ের রঙ দেখে চরিত্রায়ণ তো যুগ যুগ ধরে চলছে। ছবিতে বাড়ির 'কাজের মাসি'রা সবসময়ই শ্যামলা। নায়িকাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে কেন গায়ের রঙকেই বেছে নেওয়া হয়েছে তা তর্কাতীত। সংবাদপাঠক-পাঠিকাদের ক্ষেত্রেও শর্ত একটাই। চাপা রঙ হলেও ফোকাস লাইটের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয় 'রঙের খুঁত'। তাই সমস্যা হিসেবে যা ধরে নেওয়া হচ্ছে তার 'মূল' আসলে অনেক গভীরে।
কেন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি তাদের 'ফেয়ার' বর্জন করছে?
গ্ল্যামারদুনিয়ায় সফল এবং আত্মবিশ্বাসী মডেল নয়নিকা চট্টোপাধ্যায় ইউনিলিভারের এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশি। যদিও তিনি জানিয়েছেন, সংস্থা তাদের নাম বদলালেও সংস্থার মানসিকতা থেকে তা মুছবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। নয়নিকা বলেন, "ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স প্রতিবাদ আমরা সকলেই দেখছি। মোকদ্দমার ঝামেলা এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। এখন মানুষের মত বদলাচ্ছে, ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তারা যখন পণ্যটি বাজারে আনে সেটা কয়েক দশক আগে। সেই সময় মানুষের অনুভূতি, চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগিয়েই তারা বাজার দখল করে। এখনও সেই চিন্তাভাবনাকেই কাজে লাগাচ্ছে সংস্থা।"
প্রথম এশিয়ান হিসেবে ২০১৪ সালে মিস আমেরিকা খেতাব জয়ী নিনা দাভুলুরি (নিউইয়র্ক নিবাসী অভিনেত্রী-প্রোডিউসার) ২৩ জুন ইউনিলিভার সংস্থার আলান হোপ-কে একটি খোলা চিঠি দেন। যেখানে তিনি বলেন 'ত্বক উজ্জ্বল করে' এই ধরণের পণ্য যেন বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত নিনা 'কমপ্লেক্সিয়ন' নামক একটি ডকুমেন্ট-সিরিজেরও নির্মাতা। বর্ণবৈষম্যের জের তাঁকেও পোহাতে হয়েছে। নিনা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন, যখন তিনি মিস আমেরিকা হন সেইসময় তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, "মিস আমেরিকা এতটা কৃষ্ণাঙ্গ যে মিস ইন্ডিয়াও হতে পারেননি?"
তাহলে কি এত বছর পরও ভারতে কিছুই পরিবর্তন হয়নি?
হারপার বাজারের এডিটর ননিতা কালরা বলেন যে এটা স্পষ্ট যে এখন ভারতে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। গ্ল্যামারওয়ার্ডের প্রসঙ্গ টেনে ননিতা বলেন, "শহরের মহিলাদের মধ্যে ২ শতাংশ যাদের এই সকল চিন্তাভাবনায় বদল এসেছে। মেয়েদের গায়ের রঙ, গড়ন নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। তাই বেশ কিছু মডেলিং এজেন্সি তথাকথিত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মডেলদের দিয়ে কাজ করায় না। সঞ্জয় গর্গের মতো ডিজাইনাররা সেই স্টিরিওটাইপকে ভেঙে দিয়েছেন। বিশ্বের দিকে দেখতে হলে জামিলা জামিল উদাহরণ হতে পারেন।
ননিতা আরও বলেন, "এখন আসলে বাস্তবকেই প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে যেটা দেখান হয় সেটা আমরা চকচকে করে তুলি। ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও মহিলাদের গড়ন যাই হোক টাইট পোশাকই পরতে হবে এই ধারণা বদলেছে। এখন যে যেই পোশাকে স্বচ্ছন্দ্য সেটাই পরছে, গড়ন যাই হোক না কেন।"
এই নাম পরিবর্তনে কি আর কিছু পরিবর্তন হবে?
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যিনি প্রথম থেকে সরব হয়েছিলেন তিনি অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী বলেন, "বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য করা একটি সংস্থা বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গিয়েছে শুধু ফর্সা হবেন কী করে এটা বলতে! অনেকটা সময় লাগল তাদের বিষয়টি বুঝতে। সম্পূর্ণ ধারণা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে তাদের অবশ্য আরও সময় লাগবে।" নন্দিতা আরও বলেন, "তবে আজ আর অভিযোগ করার দিন নয়। এখনকার মানসিকতাকে নিয়ে তারা প্রচার করতে পারে নিজেদের সুবিধার জন্য। কিন্তু এমন কিছু তারা কখনই করতে পারে না যেটা সমাজে বর্ণবাদের পক্ষে কথা বলবে।"
এ বিষয়ে আরও খোলসা করে নিনা বলেন, "সংস্থাটি মানুষের মানসিকতাকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখনও বিশ্বাস করে যে ফর্সা ত্বকই আদর্শ। তারা বুঝতেই পারছেন না যে নিজেদের সাবলীল ভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা সংস্থার মতাদর্শকে পয়সা দিয়ে কিনছেন। তবে এবার দেখা যাক সংস্থাটি কীভাবে তাদের নতুন বিজ্ঞাপনের প্রচার করে। বলিউড এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেয় তাও লক্ষ্য করা উচিত। এখনও অবধি তাঁদের নীরবতাই কেবল কানে আসছে।"
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন