শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে মরক্কোতে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প কয়েকশো লোক মারা গেছেন। ঐতিহাসিক শহর মারাকেচ কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মরক্কোতে এতবড় ভূমিকম্প নজির তেমন একটা নেই। সেদেশের স্বরাষ্ট্র দফতর শনিবার সকালে জানিয়েছে যে কমপক্ষে ৬৩২ জন মারা গেছেন। যাঁদের বেশিরভাগই মারাকেচে এবং ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের নিকটবর্তী পাঁচটি প্রদেশের বাসিন্দা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট অনুযায়ী, আহত হয়েছেন আরও ৩২৯ জন। নিখোঁজদের সন্ধান এখনও চলছে।
হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে
উদ্ধারকারীরা আটলাস পর্বতমালার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তাঁদের আশঙ্কা হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা উত্তর আফ্রিকান এই দেশে এতবড় ক্ষয়ক্ষতির জন্য সমবেদনা জানিয়েছেন। সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই ভূমিকম্পের পর ফের একাধিকবার কম্পন অনুভূত হয়েছে। যাকে ভূমিকম্পের আফটারশক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শনিবার সকালে একটি এক্স বার্তায় মরক্কোকে, 'সম্ভাব্য সব সহায়তা' দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ভূমিকম্পের উৎসস্থল অগভীর
মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে অনুযায়ী, স্থানীয় সময় রাত ১১.১১ মিনিটে (আন্তর্জাতিক সময় ভোর ৩টে ৪১)-এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যার মাত্রা ছিল ৬.৮। তার মাত্র ১৯ মিনিট পরে ৪.৯ মাত্রার একটি আফটারশকে এই অঞ্চলে কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ইঘিল শহর। যা, মারাকেচ থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। ইউএসজিএস জানিয়েছে যে ভূমিকম্পের কেন্দ্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮.৫ কিলোমিটার নীচে। যদিও মরক্কোর নিজস্ব সিসমিক এজেন্সির দাবি, সাড়ে ১৮ নয়। ওটা ১১ কিলোমিটার গভীরে। যাই হোক, কম্পনের উৎসস্থলের গভীরতা অত্যন্ত গভীর নয়, এটা নিশ্চিত।
ভূমিকম্পের উৎসস্থল অগভীর হলে বিপজ্জনক
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, অগভীর উৎসস্থল হলে, সেই সব ভূমিকম্পগুলো সাধারণত বেশি বিপজ্জনক হয়। কারণ, তারা যখন ভূপৃষ্ঠে তাদের কম্পন তরঙ্গ পৌঁছে দেয়, তখন সেই কম্পনের শক্তি হয় বেশ বেশি। তার ফলে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাও বাড়ে। কিন্তু, যদি উৎসস্থল গভীর হয়, তবে, ভূপৃষ্ঠের ওপরে সেই কম্পন তরঙ্গ পৌঁছনোর আগেই নানা বাধায় তা ক্ষমতা হারায়। পাশাপাশি, গভীর উৎসস্থলের কম্পনের তরঙ্গগুলো বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে, সেই কম্পন শক্তিহীন হয়ে যায়।
একটি বিরল ভূমিকম্প
ইউএসজিএস অনুসারে, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর প্রান্তে ভূমিকম্পের হার তুলনামূলকভাবে কম। উত্তর আফ্রিকাতেও ভূমিকম্প সচরাচর হয় না। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ জিওফিজিক্সের সিসমিক মনিটরিং অ্যান্ড ওয়ার্নিং বিভাগের প্রধান লাহচেন মাহনি টুএম টিভিকে বলেছেন যে ভূমিকম্পটি পাহাড়ি অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী রূপে ধরা পড়েছে। এমনটাই জানিয়েছে সংবাদসংস্থা দ্য এপি। যার অর্থ হল যে অঞ্চলগুলোয় প্রায়শই এই ধরনের ভূমিকম্প হয়, মরক্কো তার মধ্যে পড়ে না। আর, সেই কারণে এই ধরনের বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতও ছিল না।
প্রস্তুতির অভাব
যদিও ১৯৬০ সালের এক ভূমিকম্পে মরক্কোয় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যার জেরে এই শহরের নির্মাণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু, গ্রামীণ এলাকা এবং পুরোনো শহরগুলোতে এই পরিবর্তন তেমন একটা করা সম্ভব হয়নি। তার জেরে ওই মরক্কোর ওই সব এলাকার পরিকাঠামো ভূমিকম্প রোখার জন্য তেমন একটা প্রস্তুতও ছিল না।
ওই সব অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
এবারের ভূমিকম্পে ওই সব অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারাকেচে, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, আঁটসাঁটভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো শহরের অনেক বাড়ি ধসে পড়েছে। মধ্যযুগীয় শহরের প্রাচীরে বড় ফাটল বিভিন্ন জায়গায় দেখা গিয়েছে। কোথাও বা প্রাচীন ধসে পড়ে গেছে। উদ্ধারকারী দলগুলো ধ্বংসস্তুপের নীচে থাকা মানুষদের খুঁজে বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কে মরক্কোর ভূমিকম্পপীড়িত অঞ্চলের বাসিন্দারা। তাঁদের অনেকেই ফের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় বাড়ির বাইরে অবস্থান করছেন।
উৎসস্থলের কাছাকাছি গ্রামগুলো
ভূমিকম্পের উৎসস্থলের কাছাকাছি গ্রামগুলোর অবস্থা বেজায় খারাপ। এমনই এক পাহাড়ি গ্রাম আস্নির বাসিন্দা মনতাসির ইত্রি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, 'আমাদের প্রতিবেশীরা ধ্বংসস্তূপের নীচে রয়েছে। লোকেরা নানাভাবে তাঁদের উদ্ধার করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
আরও পড়ুন- ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার বাড়বে? শেষ পর্যন্ত কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিল জি২০?
কেন মরক্কোয় ভূমিকম্প হল?
যদিও ভূমিকম্পের হার এই অঞ্চলে অত্যন্ত কম। যার ফলে মরক্কোর এই ভূমিকম্পগুকে বিরল বলা যায়। ইউএসজিএস অনুসারে, 'পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে মরক্কোর এই বড় ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।' বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'পৃথিবীর একটি প্লেটের সীমানা ইউরেশিয়ান প্লেটের সাপেক্ষে আফ্রিকান প্লেটের উত্তর দিকে সরে যাওয়ার কারণে' এই ব্যাপক ভূমিকম্প ঘটেছে। ইউএসজিএসও এটিকে, 'মরোক্কার উঁচু উচ্চ অ্যাটলাস পর্বত পরিসরে অগভীর গভীরতায় প্লেটের তির্যক চ্যুতি'র ফল বলেই মনে করছে।