বিদ্যুৎ বিলের সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের কঠোর কাঠগড়ায়। বিলের বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন। মমতার বক্তব্য, এই বিল জনবিরোধী। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ভাই-বন্ধুর পুঁজিবাদ এতে ফুরফুরিয়ে উঠবে। যদিও সরকার তা মানতে নারাজ। ফলে নতুন করে একটি লড়াইয়ের ডঙ্কা বেজে উঠেছে। আমরা বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২১-এ নজর দিয়ে বোঝা চেষ্টা করতে চাই কোথায় চিন্তা, কী-ই বা কেন্দ্রের ভাবনাচিন্তা।
বিদ্যুতে কী পরিবর্তন আনছে সরকার?
সংশোধনীতে প্রতিযোগিতায় দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির সঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে এর ফলে। ফলে কোনও গ্রাহক রাজ্য সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থা এবং কোনও বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিতে পারবেন ইচ্ছা মতো। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বাজেটেই বিষয়টির ঘোষণা করেছিলেন। প্রতিযোগিতামূলক বিদ্যুৎপরিষেবার লক্ষ্যে এই সংস্কার, বলছে কেন্দ্রীয় সরকার।
এখন দেশের বিভিন্ন অংশে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি একচেটিয়া ভাবে পরিষেবা দিয়ে থাকে। দিল্লি, মুম্বই, আমদাবাদের মতো কয়েকটি শহরে অবশ্য বেসরকারি সংস্থা পরিষেবা দেয়। যেখানেও প্রতিযোগিতা নেই, যেমন কলকাতায় সিএসসি-র একচেটিয়া কারবার। বিপুল ক্ষতিও বহন করে চলেছে সরকারি বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থাগুলি। বিভিন্ন স্কিম এনে সরকার এদের ক্ষতির এই ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে টেনে বার করার চেষ্টা চালিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অক্সিজেন দিয়েছে প্রকল্প-পদক্ষেপগুলি। তার পর আবার যে-কে-সেই। 'লসের' পথের কোনও বদল হয়নি।
আরও পড়ুন পেগাসাসে তদন্ত করছে রাজ্য সরকার, কমিশনের ক্ষমতা কী, এক্তিয়ার কতটা?
আপত্তি কোথায়?
কেকের উপরে যে চেরিটা থাকে, সেটাই খেয়ে চলে যাবে বেসরকারি সংস্থাগুলি, আপত্তি এখানেই। কী ভাবে? বিল আইনে পরিণত হলে বাণিজ্যিক, শিল্প ক্ষেত্রে তারা ঢালাও বিদ্যুৎ পরিষেবা দিতে শুরু করবে, কিন্তু আম আদমির বাড়ি বাড়ি এবং কৃষি ক্ষেত্রে তারা কাঁচকলা দেখাবে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মাশুল অনেক বেশি, সেই অতিরিক্ত অর্থেই সাধারণ মানুষ ও কৃষিকাজে বিদ্যুতের দামে ভর্তুকি দিতে পারে রাজ্যের সংস্থাগুলি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়টি তাঁর চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরে সওয়াল করেছেন: কেন্দ্রের এই বিল আইনে পরিণত হলে কেবলমাত্র শহুলে ও শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ পরিষেবা দেবে বেসরকারি সংস্থাগুলি আর গরিব এবং গ্রামীণ গ্রাহকরা পড়ে থাকবে রাজ্য নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলির হাতে।…
যদি বেসরকারি সংস্থাগুলি মৌ খেয়ে যায়, মানে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে, তা হলে কী ভাবে রাজ্যের বিদ্যুৎসংস্থাগুলির চাকা ঘুরবে কী ভাবে? তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? প্রশ্ন এমনই। তবে সব ক্ষেত্রে পরিষেবা দিতে যদি বাধ্য থাকে বেসরকারি সংস্থাগুলি, তা হলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে কিছুটা। বলছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে বৈঠকে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী আর কে সিং আশ্বাস দেন, 'বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য যে এলাকা নির্দিষ্ট হবে, তাতে শহর এবং গ্রামীণ-- দুই-ই থাকবে।' কিন্তু তার পরও অনেকের যুক্তি, যদি কমার্শিয়ালের সবাই (বা সিংহ ভাগ) (বিভিন্ন অফার বা বিজ্ঞাপনী চুম্বকে) সরকারি বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থাকে ছেড়ে বেসরকারি ছায়ায় চলে যায়, আর গরিবরা যদি সবাই (বা সিংহ ভাগ) সরকারি সংস্থাতে থাকেন, বা বিদ্যুতের মাশুলের বিচারে থাকতে বাধ্য হন, তা হলে কী করে বাতি জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব হবে সরকারের ইলেকট্রিক বাতিস্তম্ভে?
আরও পড়ুন নন্দীগ্রামের ফলের বিরুদ্ধে আদালতে যে আইনে মমতার মামলা, তার বিস্তারিত জানেন কী?
সরকার কী বলছে?
বেসরকারি সংস্থাগুলি ছাড়পত্র পেলে, প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি হবে, আদতে উপকৃত হবে সাধারণ। তা ছাড়া কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহরে কোনও একটি বেসরকারি সংস্থার আধিপত্যও খর্ব হবে, লড়াই করে পরিষেবা উপযুক্ত রাখতে হবে। আমপানের মতো দুর্যোগকালে সিএসসি যে ভাবে বিদ্যুতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই বিষয়টিও তুলছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী আর কে সিং মমতাকে খোঁচা দিয়েছেন, 'মমতা কেন বিদ্যুৎ বণ্টনে একচেটিয়া কারবার বজায় রাখতে চাইছেন?' সরকার যা-ই যুক্তি দিক, চিঁড়ে কিন্তু ভিজছে না, বাম সহ অন্য বিরোধীরাও ফুঁসছে। 'একের পর এক জন-বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে সরকার। গত বছরের শেষে আইন করে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেলবীজ, ভোজ্য তেলের মতো কৃষিপণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে কেন্দ্র। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধির ধারাল কোপ সহ্য করতে হচ্ছে জনসাধারণকে।' বলছেন বিরোধী নেতাদের অনেকেই।
বিদ্যুৎ নিয়ে এই বিল আইন হলে, অত্যাবশ্যকীয় এই পরিষেবাটির ভবিষ্যতের আলো নিভে যাবে কি না-- সেই প্রশ্নটাই বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিলটির বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়াচ্ছে। বিদ্যুৎকর্মী-আধিকারিকদের মঞ্চ এনসিসিওইই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল মঙ্গলবার, যদিও তা স্থগিত হয়েছে। কারণ এখনও বিলটি সংসদে পেশ হয়নি। সংগঠনটির অবশ্য হুঁশিয়ারি, সংসদে বিল পেশ হলেই ঘর্মঘটের ঘণ্টা বেজে উঠবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন