Advertisment

Explained: ইজরায়েল-হামাস সংকটে ইরানের ভূমিকা ঠিক কেমন? কী বলছেন বিশেষজ্ঞ?

আমেরিকা এবং ইজরায়েল অভিযোগ করেছে যে হামাসের হামলায় তেহরানের হাত রয়েছে। ইরান সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও হামাসের প্রতি ইরানের সমর্থনের কথা ওপেন সিক্রেট।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Iran's Foreign Minister Hossein Amirabdollahian, left, meets with Ismail Haniyeh, one of the Palestinian militant group Hamas leaders in Doha, Qatar, Saturday, Oct. 14, 2023.

বামে ইরানের বিদেশমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান কাতারের দোহায় শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩-এ প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়াহর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। (ছবি সৌজন্যে- এপি ও ইরানের বিদেশ দফতর)

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পশ্চিম এশিয়া সফরে। এর আগে মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইজরায়েল, বাহারিন, জর্ডান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব এবং মিশর সফর করেছেন। আম্মানে প্যালেস্তাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তুরস্কের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। কিন্তু, ইরানের প্রতি তিনি কোনও মুখ খোলেননি। আরব দুনিয়ার আঞ্চলিক শক্তি ইরান বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। পশ্চিমী দুনিয়ার অনেকেই ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইরান সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল বলেই মনে করছে। নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক একে রামকৃষ্ণান বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

Advertisment

ইজরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ইরান কী করছে?

ইরান গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি বোমাবর্ষণ, বিপুল সংখ্যক গাজাবাসীর বাস্তুচ্যুত হওয়া, গাজার উদ্বেগজনক মানবিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে তুলে ধরে আসছে। পাশাপাশি ইরান হামাসের হামলার পরিকল্পনায় এবং পরিচালনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। রাষ্ট্রসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত তাঁর দেশের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে মহাসচিবকে চিঠি দিয়েছেন। যাইহোক, হামাস প্রকৃতপক্ষে কয়েক বছর ধরে ইরানের সমর্থন পেয়েছে এবং ইরানি আধিকারিকরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তা স্বীকারও করেছেন।

আমেরিকার বিদেশসচিব ব্লিঙ্কেনের মতো, ইরানের বিদেশমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ানও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে সফর করছেন, ইরানের মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। বেইরুটে, তিনি হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন এবং একটি 'বিশাল ভূমিকম্প' সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। শুধু তাই নয়, ইরানের বিদেশমন্ত্রী হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের নেতাদের সঙ্গেও কাতারে সাক্ষাৎ করেছেন। কাতারে, আমিরবদুল্লাহিয়ান হামাসের নেতা দোহায় বসবাসকারী ইসমাইল হানিয়াহের সঙ্গে দেখা করেছেন। পাশাপাশি, গাজার পরিস্থিতি নিয়ে কাতারের নেতৃত্বের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে একটি চুক্তির প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। সেই চুক্তি অনুযায়ী, তেহরান আমেরিকান বন্দিদের মুক্তি দেবে। তার বিনিময়ে আমেরিকানরা ৬ বিলিয়ন ডলারের যে সম্পত্তি ইরানের থেকে বাজেয়াপ্ত করেছে, তা ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু, ইজরায়েলের ওপর হামাসের হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে পিছিয়ে গিয়েছে। যদিও ইরান সেপ্টেম্বরে বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরাক এবং ওমানের সঙ্গেও ইরান আলোচনা করেছে। এটি অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)-কে গাজার সংকট নিয়ে আলোচনা করতে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে একটি জরুরি সভা ডাকার আহ্বান জানিয়েছে।

ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে হামাসের হামলার পর কোনও কথা হয়েছে?

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যে গাজার বিপর্যয় নিয়ে টেলিফোনে কথোপকথন হয়েছে। যা, দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অগ্রগতির প্রমাণ। ২০২৩ সালের মার্চে চিনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের হয়েছে। তার ফলে রিয়াদ এবং তেহরানে পরস্পরের দেশে তাদের দূতাবাস পুনরায় চালু করেছে। তার পরে উভয় দেশের নেতাদের মধ্যে এই প্রথম ফোনে কথা হল।

সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইজরায়েলের সঙ্গেও আলোচনায় বসেছিল। সেই বৈঠক হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহে। ইজরায়েল এবং গাজার ঘটনা সৌদি আরবকে আলোচনার গতিপথ পুনরায় মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে এবং দেশটি আপাতত আলোচনার প্রচেষ্টাকে স্থগিত করেছে। সৌদি আরব এবং ইজরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টাকে ইরান তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করে। পাশাপাশি, ইসলামের পবিত্র স্থানগুলির রক্ষাকারী হিসাবে সৌদি রাষ্ট্র ইসলামি নীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেই ইজরায়েলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বলেও মনে করে ইরান।

একই সময়ে, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন এবং প্যালেস্তাইনে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও উদ্বিগ্ন সৌদি আরব। মার্চ ২০২৩ ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু, এটি তার নিরাপত্তার জন্য ইরানের হুমকি সম্পর্কে সৌদি আরবের ধারণাকে পুরোপুরি বদলায়নি। ইজরায়েলের জন্য, ইরানের হুমকি মোকাবিলায় সৌদি আরবের সঙ্গে একটি চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনও পর্যন্ত ইরান, ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদিদের আলোচনা স্থগিত করতে বাধ্য করেছে।

প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক কী?

১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লব প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলের প্রতি ইরানের নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। বিপ্লব মুস্তাজাফিন, নিপীড়িত, মুস্তাকবিরিন, নিপীড়কদের বিরুদ্ধে, এমন কিছু বিষয় যা ইহুদিবাদ বিরোধী এবং প্যালেস্তাইনের সংগ্রামের প্রতি সমর্থনকারী। মুহম্মদ রেজা শাহ পাহলভির রাজতন্ত্রের পতনের পর নতুন ইরানি শাসনের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল তেহরানে ইজরায়েলি দূতাবাস ভবন প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) কাছে হস্তান্তর করা। ইরানের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মেহেদি বাজারগান এবং পিএলওর ইয়াসির আরাফাত দূতাবাস ভবনের চাবি হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইরানের বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনি রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল-কুদস দিবস (জেরুজালেম দিবস) হিসেবে ঘোষণা করেছেন। যা প্যালেস্তিনীয়দের সমর্থনের দিন হিসেবে পালন করা হয়।

পিএলও-এর মাধ্যমে প্যালেস্তাইনের প্রতি ইরানের সমর্থন ধাক্কা খেয়েছিল সেই সময়, যখন আরাফাত আট বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধে (১৯৮০-৮৮) সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। পরে ইরানও, ইজরায়েলের সঙ্গে পিএলওর আলোচনার সমালোচনা করেছে। ইরান তখন প্যালেস্তাইন ও লেবাননে নতুন বাহিনী নিয়ে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটি 'প্রতিরোধের অক্ষ' গঠনে কাজ শুরু করে। হামাস, ১৯৮৭ সালের প্যালেস্তিনীয় ইন্তিফাদা (অভ্যুত্থানের)-র প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়। আর, ইসলামিক জিহাদ প্যালেস্তাইনে ইরানের সমর্থন পাওয়া প্রধান সংগঠনে পরিণত হয়।

হিজবুল্লাহ ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক কেমন?

হিজবুল্লাহ একটি শিয়া সংগঠন যা ১৯৮২ সালে লেবাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ইরানি বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। হামাস একটি প্রধানত সুন্নি সংগঠন। এই দুটো সংগঠনই ইরানের দুটি প্রধান মিত্র। যার অর্থ শিয়া হোক বা সুন্নি, ইসলামি মৌলবাদ ছড়ানোই ইরানের প্রধান উদ্দেশ্য। গাজার বর্তমান যুদ্ধ ইজরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছে। আর, এই সংঘাত একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ভূমিকা এবং ইজরায়েলের সঙ্গে এর কয়েক দশকের দীর্ঘ দ্বন্দ্ব সাধারণভাবে পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের প্রচেষ্টা এবং বিশেষ করে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের প্রতি তার নীতির ওপর আন্তর্জাতিক সংস্থার তদন্তের ঘটনা বৃদ্ধি করেছে।

ইজরায়েলও ইরানকে তার এক নম্বর আঞ্চলিক শত্রু মনে করে। এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হামলার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রথম দিন থেকেই ইজরায়েলকে কূটনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার নীতি নিয়েছে ইরান। তবে, ইরান সম্পূর্ণভাবে সচেতন যে বর্তমান সংঘাতের যে কোনও আঞ্চলিক বৃদ্ধি আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকার কারণে তাদের দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি মোকাবিলার চেষ্টার পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।

(এ কে রামকৃষ্ণান নয়াদিল্লিতে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে, সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক।)

Hamas Israel-Palestine clash Iran Qatar USA
Advertisment