Advertisment

সুভাষ-মূর্তি থেকে অমর জ্যোতি, সৈনিকের বেশে বিতর্ক, কী ভাবে?

ভারতীয় শহিদ সেনা হোন কিংবা সৈনিক দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কেউই কোনও শাসনে ভোটের উপরে উঠতে পারেন না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Amar Jawan Jyoti

বিভিন্ন যুদ্ধে ভারতীয় যে সব সেনা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় ইন্ডিয়া গেটে জ্বালানো হয়েছিল অনির্বাণ শিখা।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হলোগ্রাম মূর্তি আজ থেকে ইন্ডিয়া গেটের দ্রষ্টব্য হল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই হলোগ্রামের উদ্বোধন করলেন। ২৩ জানুয়ারি, নেতাজির ১২৫ জন্মদিন এই ভাবে তাৎপর্যের নতুন চরিত্রে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে এ রাজ্যের নেতাজি ট্যাবলো বাতিলের প্রসঙ্গ তুলে এই মূর্তি উদ্বোধনকে বিচার করছেন অনেকে। ট্যাবলো বাতিলে সুভাষচন্দ্র বসুকে অমর্যাদা করেছে কেন্দ্র, এমনই গুরুতর অভিযোগ। সেই অভিযোগ কি পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে ইন্ডিয়া গেটে নেতাজি মূর্তির আলোয় ঢেকে দিতে চাইলেন মোদী-শাহরা, প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ট্যাবলো নাকচের পর যে চিঠি লিখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার জবাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানান, এই সিদ্ধান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। কিন্তু এতে ভবি ভোলবার নয় মোটেই। প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার জানিয়েছিলেন ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির মূর্তি বসবে, যা গ্রানাইট পাথরে তৈরি, যত দিন না ওই মূর্তি বসছে তত দিন থাকবে হলোগ্রাম। যেখানে আজ নেতাজির মূর্তি-আবির্ভাব, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত রাজা পঞ্চম জর্জের মূর্তি ছিল সেইখানে।

Advertisment

এ দেশে ভোট বড় বালাই, ভোটের জন্য তো কত কিছু হয়। যেমন অনেকেই বলে থাকেন ইন্ডিয়া গেট থেকে কিছু দূরে ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালটিও ২০১৯-এ ভোটের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। বীর সেনার শ্রদ্ধায় কতটা দায়িত্ববান মোদী সরকার, তা তুলে ধরাই ছিল ওই নির্মাণের উদ্দেশ্য। যদিও বিজেপির নেতারা এই অভিযোগকে বাতুলতা বলে থাকেন। পরিবর্তন চক্রবৎ, ভোট আবারও আসছে, পাঁচ রাজ্যে ভোট দোরগোড়ায়, ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন, লগ্নটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ ওই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে একটি, যে রাজ্য নাকি কেন্দ্রের কুরসির পথটা দেখায়। ফলে, যেমন নেতাজি, তেমনই অমর জওয়ান জ্যোতি নির্বাপণ এখন ইস্যু। ইন্ডিয়া গেটের এই জ্যোতি-বিয়োগ হয়েছে শুক্রবার। এই ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে মহা-ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। আসুন, জ্যোতি-বিতর্কে একটু নজর দিই এবার।

বিতর্কে অনির্বাণ জ্যোতি

শিখাটি ইন্ডিয়া গেটে জ্বলেছিল পাঁচ দশক ধরে। কেন্দ্রের মোদী সরকার তা নিভিয়েছে শুক্রবার। থুড়ি, নেভানো হয়নি। সেই শিখা ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালের অনির্বাণ শিখার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাহুল গান্ধি সহ কংগ্রেসের তাবড় নেতারা স্বাভাবিক ভাবেই তোপ দেগেছেন। মোদী সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে কর্মসূচি নিক কংগ্রেস, এমন দাবিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধিকে চিঠি লিখেছেন বঙ্গের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। কংগ্রেস দেশ জুড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে এই ইস্যুতে নামবে কিনা তা নিয়ে জল্পনা চলছে। কিন্তু বলাই যায়, তবে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের আগে এই ঘটনা বিজেপির বিরুদ্ধে না চাইতেই বেশ ধারাল অস্ত্র এনে দিয়েছে কংগ্রেসের করকমলে।

অমর জওয়ান জ্যোতি কী?

বিভিন্ন যুদ্ধে ভারতীয় যে সব সেনা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় ইন্ডিয়া গেটে জ্বালানো হয়েছিল অনির্বাণ শিখা। ১৯৭২ সালে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জয়ের পর। যে জয় এনে দিল স্বাধীন বাংলাদেশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি সে বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে এই শিখার উদ্বোধন করেন। এল-ওয়ান এ-ওয়ান সেলফ লোডিং রাইফেল। নলের দিকটা নিচে, বাঁটের উপর সেনাটুপি, বা যুদ্ধের শিরোস্ত্রাণ। কালো মার্বেল পাথরের উপর যা দণ্ডায়মান। নির্মাণে রাখা চারটি পাত্র, চারটি বার্নার তাতে। যেখানে জ্বালানো হত অগ্নিশিখা। এমনি দিনে এ চারটির মধ্যে একটি জ্বলত, বিশেষ দিন, যেমন প্রজাতন্ত্র দিবসে চারটিই জ্বলত। একেই অমর জওয়ান অনির্বাণ শিখা বলা হত। অনির্বাণ, কখনও নেভে না, আক্ষরিক অর্থেই কখনও নিভতে দেওয়া হয়নি শহিদ সেনার প্রতি শ্রদ্ধার এই অগ্নিকে।

কী করে এই শিখা জ্বালিয়ে রাখা হত?

ইন্ডিয়া গেটের নীচে ৫০ বছর ধরে এই শিখা জ্বলেছিল। কিন্তু প্রথম দিকে যেমন ভাবে জ্বলত, পারে তা হত না। প্রথমে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি-র মাধ্যমে এইটি জ্বলত। একটি এলপিজি-র একটি সিলিন্ডারে একটি বার্নার জ্বলত দেড় দিন। তবে ২০০৬ সালে এই পদ্ধতির বদল ঘটানো হয়। কারণ খরচটা বেশি হয়ে যাচ্ছিল। এলপিজি থেকে পিএনজি-র মাধ্যমে শিখা জ্বালানো শুরু হয় শিখা।

কেন ইন্ডিয়া গেটের নীচে?

ব্রিটিশরা ইন্ডিয়া গেট তৈরি করেছিল ১৯৩১ সালে। ব্রিটিশ সেনায় ৯০ হাজারের মতো শহিদ ভারতীয় সেনার প্রতি শ্রদ্ধায় এর নির্মাণ। যে সব সেনা মারা যান নানা যুদ্ধে। স্মৃতি সৌধে সেই উল্লেখ রয়েছে। ১৩ হাজার নিহত সেনার নাম স্মরণ করা হয়েছিল তখন। যেহেতু ভারতীয় শহিদ সেনাদের স্মরণে ইন্ডিয়া গেট, সেই জন্য অমর জওয়ান জ্যোতি ওই নির্মাণের নীচেই জ্বালানো হয়।

কেন নেভানো হল এই অনির্বাণ অগ্নিশিখা?

বিতর্ক এ নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্পষ্ট কথা, নেভানো হয়নি শিখা, এটি ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালের অনির্বাণ শিখার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সূত্রের বক্তব্য, মূলত ১৯৭১ সালের যুদ্ধে শহিদ ভারতীয় সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় এটি প্রজ্জ্বলিত করা হয়, কিন্তু তাঁদের নাম উল্লেখ করা নেই কোথাও। আর ইন্ডিয়া গেট উপনিবেশিক শাসনের প্রতীক। ফলে এটি নেভানো হয়েছে।

তবে বলা হয়েছে, '১৯৭১ সহ সমস্ত যুদ্ধে শহিদ ভারতীয় সেনাদের নাম রয়েছে ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে। এটাই শহিদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।' প্রতিরক্ষা মহলের বক্তব্য, ২০১৯ সালে, ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরির পর, এ দেশের রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা স্তরের সকলেই ওই মেমোরিয়ালে শ্রদ্ধার্পণ করে থাকেন। বিদেশ থেকে আসা অতিথিরাও তা-ই করেন। যা আগে অমর জওয়ান জ্যোতি-তে হত। ফলে দুটি অনির্বাণ জ্যোতির এখন আর প্রয়োজন নেই। যদিও ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরির সময় নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছিল, দুটি শিখাই অনির্বাণ থাকবে।

শিখা নির্বাপণের পিছনে উঠে আসছে আর একটি তত্ত্বও। অনেকে বলছেন, ২০১৯-এ শহিদ-স্মরণে নতুন স্মৃতিসৌধ ওই ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরি, কিন্তু এটি ফোকাসে থাকছিল না। অমর জওয়ান জ্যোতি-র মতো এর নামও ছড়ায়নি, তাই জ্যোতি নিভে গেল।

ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল সম্পর্কে

ইন্ডিয়া গেট থেকে ৪০০ মিটার দূরে ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। না, হঠাৎ করে এর নির্মাণ হয়নি, ১৯৬১ সাল থেকেই এটি তৈরির ভাবনাচিন্তা চলছিল। কিন্তু হয়নি নানা কারণে। ২০১৫ সালে, মোদী সরকার এর নির্মাণে সিলমোহর দেয়। এর নকশা বাছা হয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এখনও পর্যন্ত এখানে সোনার হরফে লেখা হয়েছে ২৬ হাজার ৪৬৬ জন বীর সেনার নাম।

সেনারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন এ দেশে, এটাই ভারতের দস্তুর। পাকিস্তানের মতো পড়শি দেশে যার উল্টোটা হয়। সেখানে রাজনীতিকরা সেনার কথায় ওঠেন-বসেন, কখনও হারিয়েও যান। ভারতের রাজনীতিতে এই সেনা-বিচ্ছিন্নতা কিন্তু এক-তরফা, মানে সেনাপক্ষ এখানকার রাজনৈতিক কার্যে নাক না গলালেও, সেনার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে রাজনীতি হয়। সৈনিকের মৃত্যুতে ফেনিল তুফান ওঠে রাজনীতির লড়াইয়ে। ভোট এলে তো আরও বেশি করে হয় এ সব। ফলে ভারতীয় শহিদ সেনা হোন কিংবা সৈনিক দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কেউই কোনও শাসনে ভোটের উপরে উঠতে পারেন না। পারবেনও না।

Netaji Subhash Chandra Bose India Gate Amar Jawan Jyoti
Advertisment