দুই বিজেপি সাংসদ। দুই পৃথক রাজ্যের দাবি। নতুন করে রাজ্য রাজ্যনীতির কড়াইয়ের তেল ফুটন্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদের শনশন হাওয়া। দু’জনের দুই বক্তব্য তাঁদের ব্যক্তিগত। বলে বিজেপি নেতৃত্ব দূরে। কিন্তু তাতে বিজেপির দুই সাংসদের বিরাট দাবির বিরাটত্ব বড় একটা হ্রাস পাচ্ছে কি? তা হলে নির্বাচনে হেরেই কি এবার পৃথক রাজ্যের দাবির তাওয়ায় রুটি সেঁকতে চাইছেন মরিয়া গেরুয়া নেতাদের একাংশ? প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
কী বলেছেন দুই বিজেপি সাংসদ?
জুনের ১৩ তারিখ, জন বার্লা, আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ, বললেন, উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হোক। কারণ, এই অঞ্চল অবহেলিত। বহু বছর ধরেই। এর পর ২১ জুন, বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ জঙ্গলমহলকে আলাদা রাজ্য করার দাবি তুললেন। উন্নয়নের অভাবকেই দাবির পিছনে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেছেন সৌমিত্র।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ সব নিয়ে কী বললেন?
তাঁর কথা হল, রাজ্য ভাগাভাগির দাবি বিজেপির এই সব নেতার ব্যক্তিগত, এর সঙ্গে পার্টি লাইনের কোনও সম্পর্ক নেই। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও ধরনের বিভাজনের বিরুদ্ধে। অনেকের প্রশ্ন, দলের লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন বিস্ফোরক বক্তব্য পেশ করার জন্য কি ওই দুই সাংসদের বিরুদ্ধে এবার ব্যবস্থা নেবে বিজেপি? এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অনেক পুরনো। তা নিয়ে রাজনীতির শিকড়ও অনেক গভীরে। তাতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিও চলছে। একটু নজর দেওয়া যেতে পারে।
গোর্খাল্যান্ড
দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স, তরাইয়ের একাংশ নিয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবি প্রাচীন। ৮০-র দশক থেকে যা হিংসাত্মক চেহারা নেয়। গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জিএনএলএফ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। সুবাস ঘিসিংয়ের দল জিএনএলএফ। তাদের স্পষ্ট কথা, উন্নয়ন এখানে মেঘে ঢাকা। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, স্কুল এবং চাকরির নেই-রাজ্য। আন্দোলন শিখরে উঠল ১৯৮৫-৮৬-তে। রক্তে ভেসে গেল পাহাড়। মৃত্যু হল ১ হাজার ২০০ জনের। তার পর দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল গড়ে এই আন্দোলনের একটা হিল্লে করলেন সেই সময়ের বাম শাসকরা। কিছু ক্ষমতা পেলেন পাহাড়িয়া নেতারা। যে কাউন্সিল তার পর ২৩ বছর পাহাড় চালাল।
২০০৭। নতুন করে গোর্খাল্যান্ডের দাবি হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাহাড়ের গায়ে। সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফের নেতা বিমল গুরুং দলত্যাগ করে ঢেউ তুললেন। গড়লেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। ২০১১, ২০১৩, ২০১৭। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নানা তরঙ্গ দলটির নেতৃত্বেই। ২০১১ সালে এতে লাগাম দিতে পুরনো ছকে গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) তৈরি হল। দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা ডিজিএইচসি পরিত্যক্ত হল। কিন্তু গুরুং ২০১১-তে জিটিএ থেকে পদত্যাগ করে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে পুনর্জীবিত করে তুললেন।
২০০১৭-র শেষ দিকটায় গোর্খাল্যান্ড নিয়ে যে আন্দোলন হল, তা অনেকের চোখে ভাসছে এখনও। ১০৪ দিন ধরে পাহাড়ে শিকল। সব বন্ধ। হিংসার স্রোতও। শেষে গুরুং পালালেন, রাজ্য পুলিশও তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। বিমলের তল্লাশিতে গিয়ে গুলিতে নিহত সাব-ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিক। বিমল অভিযুক্ত হলেন হত্যা মামলায়। তিন বছর পর, একটা চমকের ঘটনা। মানে গত অক্টোবরের ২১ তারিখ, পঞ্চমীর দিন। কলকাতায় এসে উপস্থিত হলেন এই পলাতক নেতা।
বিজেপির বৃদ্ধি
২০০৯ সালে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনে দার্জিলিং লোকসভা জেতে বিজেপি। ২০১৪-তেও তারা ওই আসন জেতে, ১৯ সালেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। গোর্খাল্যান্ড দাবির প্রতি বিজেপির সহাভূতি দেখানোই জিতের পিছনে, মনে করেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, মুখে বিজেপি গোর্খাল্যান্ডের বিরুদ্ধে বলে থাকে, ভিতরে ভিতরে ঠিক উল্টোটা। তাদের প্রায় সোনার পাথরবাটি অবস্থান পাহাড়ে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্ত সংসদে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে যে মন্তব্য করেন, তাতেও যথেষ্ট জলঘোলা হয়। তৃণমূল অভিযোগ করে, রাজু গোর্খাল্যান্ডের দাবির আগুন উসকাচ্ছেন। এমনকী আত্মগোপনপর্বে কেন্দ্রীয় বিজেপির নেতাদের অনেকের সঙ্গে বিমল গুরুংদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল বলেও নানা সূত্র থেকে সামনে এসে হাজির হয়েছিল। না হলে ১৯-এর লোকসভায় পাহাড়ে গেরুয়া পতাকা পোঁতা বিজেপি পক্ষে সম্ভব হত না বলেও অনেকের বিশ্লেষণ।
যদিও গত অক্টোবরের শেষে বিমল ওই আত্মপ্রকাশের পর বলেন, এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ। পুনঃ মুষিক ভব হল কি না জল্পনা শুরু হয়। তৃণমূলের সঙ্গে বিমলের নয়া সমীকরণ তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারিতে গুরংয়ের উপর থেকে ২০০৭ সাল থেকে দায়ের মামলাগুলি প্রত্যাহার করে নেয় রাজ্য। যদিও তাতে বিধানসভায় উত্তরবঙ্গ জয় বিজেপির আটকায়নি। বিজেপি গোর্খাল্যান্ড দেবে, এই আশাতেই কি আবার পদ্মেই ভোট দিলেন পাহাড়বাসী?
কামতাপুর, গ্রেটার কোচবিহার
কামতাপুর পৃথক রাজ্যের দাবি কোচ-রাজবংশীদের। উত্তরবঙ্গের আটটা জেলার মধ্যে সাতটা,কোচবিহার এর কেন্দ্র, অসমের কোকরাঝাড়, বঙ্গগাইগাঁও, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বিহারের কিসানগঞ্জ এবং নেপালের ঝাপা নিয়ে কামতাপুর দাবি। ১৯৬৯ থেকে পৃথক কামতাপুর রাজ্যের আন্দোলন শুরু।
১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। কামতাপুর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের কিছু সদস্য মিলে তৈরি করলেন কামতাপুর লিবারেশন অরগাইজেশন বা কেএলও। সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কামতাপুর গঠনই লক্ষ্য। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম বা উলফা (ULFA) কেএলও-র সদস্যদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিল। ভুটানে উলফার বেসক্যাম্পে কেএলও-র আস্তানাও তৈরি হল। ২০০৩ সালে। ভারতের ভয়ানক চাপের মুখে ভুটানে উলফা, কেএলও এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অফ বোরোল্যান্ড বা এনডিএফবি-র ঘাঁটিতে হামলা চালায় ভুটান রয়্যাল আর্মি। ভারতীয় সেনা তাদের সাহায্যে করে। গুঁড়িয়ে গিয়েছিল জঙ্গি ক্যাম্পগুলি।
২০০৩-এর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০০৪-এর ৩ জানুয়ারি। চলে এই জঙ্গি নিধনপর্ব। নাম, অপারেশন অল ক্লিয়ার। এর পর এই আন্দোলন অনেকটা থিতিয়ে গেল। কিন্তু মরেনি, বিচ্ছিন্নতাবাদ সহজে মরে না। নব নব রূপে এসে হাজির হয়, রাজনৈতিক আশকারায়। খোলস পাল্টায়। এ দিকে, কামতাপুরের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যেই এখানে গ্রেটার কোচবিহারের আন্দোলন শুরু হয়েছে। দাবি গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য। ১৯৯৮ সালে গ্রেটার কোচবিহার পিপল’স অ্যাসোসিয়েশন এই আন্দোলনের দামামা বাজায়। সাধারণ সম্পাদক বংশীবদন বর্মন।
২০০৫ সালে গ্রেটারের অনশন আন্দোলনে রণক্ষেত্র কোচবিহার। জেলাশাসকের দফতর অভিযানে আন্দোলনকারীরা। বিশাল মিছিল এগতে থাকে। পুলিশ মিছিল আটকে দিলে অশান্তি। তীব্র সংঘর্ষ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সহ ৩ পুলিশ কর্মী নিহত। দুই আন্দোলনকারীও শেষ। এর পর বংশীবদনের আত্মসমর্পণ ২০০৫-এর ২০ সেপ্টেম্বর। ২০০৬ সালে বংশীর ঘনিষ্ঠরা আবার গঠন করলেন কোচবিহার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা জিসিবিডিপি নামে একটি দল। বোঝাই যাচ্ছে দাবি একই। বংশী এই দলটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে শুরু করেন জেল থেকে। ২০০৯ সালে জেলে থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে বংশী নির্বাচনও লড়েন। ২০১১-য় রাজ্যের পালাবদলের পর, তিনি ছাড়া পেলেন। তার পর কিছু দিন চুপ থেকে ফের স্বমূর্তিতে আসার চেষ্টা করলেন।
২০১৩-য় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নতুন করে শুরু হলে কামতাপুর ও গ্রেটার কোচবিহারও চাগাড় দিল। কামতাপুর পিপলস পার্টি, কামতাপুর প্রোগ্রেসিভ পার্টি এবং গ্রেটার কোচবিহার পিপলস পার্টি একই সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ল।
এদিকে, কোচবিহার পিপলস আসোসিয়েশনের আরেক নেতা অনন্ত রায়, যিনি আবার রাজবংশীদের মহারাজা বলে পরিচিত, তাঁর সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়ে গিয়েছে বংশীবদনের। দুই শিবিরের দুই পথ, পথ বলে দাও…। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সমর্থন জানান অনন্ত রায়রা। বীরপাড়ায় নরেন্দ্র মোদীর সভাতেও তাঁকে দেখা যায়। এমনকী বংশীবদনকে দলে টানতে বিজেপির মরিয়া চেষ্টার খবর চাউর হয় তখন। যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু না ঘটায়, তৃণমূলের অসীম স্বস্তি মিলেছে।
অনন্ত-সাক্ষাৎ
বিধানসভা ভোটের আগে, ১১ ফেব্রুয়ারি, রাজবংশীদের ‘মহারাজা’ অনন্ত রায়ের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একাধিক মামলার জেরে এ রাজ্যে গ্রেফতারের ভয়। অসমের চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে থাকেন গ্রেটার কোচবিহার পিপল’স অ্যাসোয়েশনের এই মুখিয়া। এই সাক্ষাতে শাহ নানা প্রতিশ্রুতি দিলেন অনন্তকে। পিপল’স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি অনুযায়ী ভারতীয় সেনায় নারায়ণী ব্যাটালিয়ন গড়ার প্রতিশ্রুতিও। অনেকে বলতে শুরু করেন, রাজবংশীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সহাভূতির হাওয়া দিয়েই সমর্থন ধরে রাখতে চাইছে বিজেপি। ভোট বড় বালাই, আবারও প্রমাণ হচ্ছে। যদিও বংশীবদন বর্মনের বাঁশিতে সুর তৃণমূলেরই। ভোটের আগে বিজেপিকে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন তিনি।
বিচ্ছিন্নতাবাদে হাওয়া
রাজ্যে হার। উত্তরবঙ্গে বিজেপির ভাল ফল। তার পর থেকেই উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার দাবি বিজেপির কর্মীসমর্থকদের একাংশের। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই দাবিতে পোস্টও। জন বার্লার গলাতে সেই শব্দই লেগেছে।
আর জঙ্গলমহল? সৌমিত্র খাঁ বললেন, ‘চিরকাল জঙ্গলমহলের মানুষ বঞ্চিত। এখন কলকাতাসংলগ্ন এলাকার বিধায়কদের নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভা। তাঁরাই সারা রাজ্য চালান। তাই আজ জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য পৃথক রাজ্য চাই।’
বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি সারা দেশে বহু। সংখ্যাটা কুড়িরও বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, হাওয়া পেয়ে বিচ্ছন্নতাবাদীদের ছাই চাপা আন্দোলনের আগুন যদি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের চেহারা নেয়, তার দায় কে নেবে?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন