কোভিড-তালা খুলে স্কুল চালু হয়েছে। ইস্কুলে আহ্লাদের দিন ফিরে এসেছে। বিদ্যালয়গুলির কলরব-কলেবরে পক্ককেশদের বুক স্বস্তিতে উঠছে, পড়ছে। নব-নর্মালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই নবজাগরণ। তবে দরজাটা খুলেছে শুধু বড়দের জন্য। সব মিলিয়ে কী হল শিক্ষাদীক্ষায়, তার সমীক্ষাও হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব ফলাফল। কী সেটি? দেখা গিয়েছে, সরকারি স্কুলে ভর্তিতে এসেছে স্রোতের বিপরীত ছবি, বিশাল লাফ। বেসরকারি স্কুলগুলিতে তার উল্টো ছবি, স্বাভাবিক ভাবেই। সেই সব স্কুলে ভর্তিসংখ্যা হয়েছে ১০ বছরে সর্বনিম্ন। পাশাপাশি, প্রাইভেট টিউশন এবং ডিজিটাল বৈষম্যের প্রভাবও পড়েছে পড়ুয়াদের উপর, বলছে সমীক্ষা।
অ্যানুয়াল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট বা ASER, যা এ দেশের এই জাতীয় একটি পুরনো সমীক্ষা, প্রথম এডুকেশন ফাউন্ডেশন সমীক্ষাটির সহযোগী। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ও তার ব্যবস্থা-পদ্ধতিতে এই সমীক্ষাটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় রীতিমতো। মহামারি কালে শিক্ষার সুযোগের উপর আধারিত এই সমীক্ষা রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে বুধবার। যাত্রা শুরুর পর থেকে এটি সংস্থার ১৫তম রিপোর্ট। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে সমীক্ষাটি করা হয়েছে। অংশ নিয়েছে ২৫টি রাজ্য এবং তিনটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ৫৮১ গ্রামীণ জেলার ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৭৫ হাজার ২৩৪ জন শিশু। প্রাইমারি বিভাগ থাকা ৭ হাজার ২৯৯টি সরকারি স্কুলের শিক্ষক অথবা প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন সমীক্ষকরা।
রিপোর্টের মোদ্দা কথা
সমীক্ষা স্পষ্ট ভাবে দেখিয়ে দিয়েছে উল্টো স্রোতটা। প্রাইভেট স্কুলগুলি থেকে যে স্রোত চলেছে সরকারি স্কুলের দিকে। সরকারি স্কুলে ভর্তির হার ২০১৮ সালে ছিল ৬৪.৩ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬৫.৮ শতাংশ। ২০২১ সালে আরও বেড়ে-- ৭০.৩ শতাংশ। প্রাইভেট স্কুলে এনরোলমেন্টের হার ২০২০ সালে ছিল ২৮. ৮ শতাংশ, ২০২১ সালে কমে হয়েছে ২৪.৪ শতাংশ। এএসইআর সেন্টার ডিরেক্টর উইলিমা ওয়াধা এবং প্রথম ফাউন্ডেশনের সিইও রুক্মিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ২০০৬ সাল থেকেই সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তির হার কমছে। ২০১৮ সালে যা পৌঁছেছিল ৬৫ শতাংশের নীচে। মহামারি-কালে এই বৃদ্ধি, উল্টো গতিটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
টিউশন নির্ভরশীলতা
সার্ভে জানাচ্ছে, প্রাইভেট টিউশনে নির্ভরশীলতা বেড়েছে। বিশেষ করে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। এখন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে সব মিলিয়ে ৩৯.২ শতাংশ ছেলেমেয়ে। স্বল্প শিক্ষিত পরিবারগুলির পড়ুয়াদের ভিতরে ২০১৮ থেকে ২০২১ মধ্যে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার হার বেড়েছে ১২.৬ শতাংশ। তুলনায় উচ্চ শিক্ষিত পরিবারগুলির পড়ুয়াদের প্রাইভেট টিউশনে পড়ার হার এই সময়ে বেড়েছে ৭.২ শতাংশ। সমীক্ষার মাপকাঠি অনুযায়ী, যে সব পড়ুয়ার অভিভাবক পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়শুনো করেছেন, তাঁদের পরিবারগুলিকে লো এডুকেশন বা স্বল্প শিক্ষিত পরিবার বলা হচ্ছে। যাঁরা ন্যূনতম নবম শ্রেণি উত্তীর্ণ, তাদের ফেলা হয়েছে হাই-এডুকেশনে।
ডিজিটাল ডিভাইস
প্রযুক্তি বিষয়ে অজ্ঞতা, নিম্নবর্গের পরিবারগুলির পড়ুয়াদের বড় অংশ জিটিটাল পড়াশুনোর সুযোগ নিতে পারেনি। বিশেষ করে যারা পড়াশুনোর প্রথম ধাপে পা দিয়েছে, গগনচুম্বী সমস্যায় পড়েছে তারা। বলছে সমীক্ষা।
এএসইআরের ডিরেক্টর সুমন ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ-- প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের তিন জনের মধ্যে একজন ক্লাসরুম কী জিনিস জানে না। সরকারি স্কুলের মধ্যে সব মিলিয়ে এই সংখ্যাটা ৩৬. ৮ শতাংশ এবং প্রাইভেট স্কুলগুলির মধ্যে ৩৩.৬ শতাংশ।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সুমন জানিয়েছেন, 'এই সব ছাত্র মহামারি-কাল কাটিয়ে স্কুলে ঢুকলে স্কুল ব্যাপারটা বুঝতে তাদের সময় লাগবে। কারণ, এই পড়ুয়াদের প্রিপ্রাইমারি স্কুল কিংবা অঙ্গনওয়াড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়নি।' সমীক্ষা জানাচ্ছে, ইন্টারনেট-স্মার্টফোনে ব্যবহারের বিচারেরও এই সব প্রথম-পড়ুয়ারা তলানিতে। দেখা গিয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের তিন ভাগের এক ভাগের বাড়িতেই স্মার্টফোন নেই। যদিও স্মার্টফোনের ব্যবহার যে বাড়ছে, তাও উঠে এসেছে সার্ভেতে। সমীক্ষা বলছে, স্কুলে ভর্তি হওয়া যে সব ছাত্রের বাড়িতে অন্তত একটি স্মার্টফোন ফোন রয়েছে, সেই সংখ্যা ৩৬. ৫ থেকে পৌঁছেছে ৬৭.৬ শতাংশে। তবে ক্লাস ওয়ান এবং টুয়ে পড়া পড়ুয়াদের মাত্র ১৯. ৯ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পেরেছে। বয়সের সঙ্গে সংখ্যাটা বেড়েছে অবশ্য। নবম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ।
রুপোলি রেখা
সমীক্ষা বলছে, স্কুলের বাইরে থাকা ১৫-১৬ বছরের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা ২০১০ সালে ছিল ১৬.১ শতাংশ। সরকারি প্রচেষ্টায়, সেই তা কমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে। ২০১৮-এ পৌঁছয় ১২.১ শতাংশে। এই কমতিই জারি রয়েছে। দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে এর সংখ্যাটা ৯.৯ শতাংশ এবং ২০২১-এ সেই হিসেব ৬.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। যা আশার আলো দেখাচ্ছে বৈকি!
তা ছাড়া এই সমীক্ষা আরও ভালর দিক দেখিয়েছে। যেমন ৯১.৯ শতাংশ পড়ুয়ার টেক্সটবুক রয়েছে। বলেছে রিপোর্ট। (যদিও পরে হোঁচট আছে) বলা হয়েছে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের মাত্র তিন জনের একজন, মানে ৩৩.৫ শতাংশ, বইপত্র পেয়েছে। সমীক্ষা বলেছে, অভিভাবকদের মধ্যে মাত্র ২৮.৫ শতাংশ শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদের সন্তানদের পড়াশুনো প্রসঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শিক্ষাগত মানের উপরেই বিষয়টি নির্ভর করেছে।
মহামারিকালে অনলাইন শিক্ষা হয়ে উঠেছে বল-ভরসা। কিন্তু দুধের সাধ কখনও ঘোলে মেটানো যায় না। তা ছাড়া শিশুদের স্কুলসভ্যতার সমীপে আসা কতটা প্রয়োজন আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছি, না বোঝারও কিছু ছিল না। তাই বড় পড়ুয়াদের স্কুলে যেতে দেখে ছোটদের চোখের সামনে শিক্ষালয়ের সিংহ দরজা খোলার ছবিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। করোনা মাড়িয়ে তারাও খুব দ্রুত স্কুলপথে এগিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। সেই কাউন্টডাউন বোধ হয় শুরু হয়েছে ভাবলে মন্দ কি!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন