মুদ্রাস্ফীতি শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীর মাথাব্যথার কারণ এখন। বৃহস্পতিবার আরবিআই সুদের হার বাড়ায়নি অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোকে সুনিশ্চিত করতে, এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি খড়গ তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে-- সুদের হার বাড়ালে যা নিয়ন্ত্রণে আসে-- বিশেষ করে রিভার্স রেপো রেট। মানে আরবিআই ব্যাঙ্কগুলির থেকে স্বল্প মেয়াদি যে অর্থ নেয়, তার উপর সুদের হার, সেটা বাড়ানো দরকার হয়ে পড়ে মুদ্রাস্ফীতিকে লাগাম দিতে। রিভার্স রেপো রেট বাড়া মানে ব্যাঙ্কগুলির কাছে বেশি পরিমাণে সুদ বাবদ অর্থ আসা। এখন এই বাড়তি সুদের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাঙ্কগুলি আরও বেশি অর্থ আরবিআইকে দেয়, তাদের কাছে যে বাড়তি বা সারপ্লাস অর্থ এসে হাজির হয়েছে, সেইটা বেরিয়ে যায়। বাজারে নগদ কমে, মুদ্রাস্ফীতি কমে।
তা হলে কেন আরবিআইআই এবার রিভার্স রেপো বাড়াল না?
রিভার্স রেপো বাড়ালে ব্যাঙ্কগুলি গৃহঋণে সুদের হার বাড়াবে। কারণ তখন তাদের কাছে অর্থ ঋণ হিসেবে সাধারণকে দেওয়ার চেয়ে সরকারি সিউকিরিটিতে সঞ্চয় করা বেশি লাভজনক। অর্থনীতির নাজেহাল দশা এখন, ঋণের সুদ বৃদ্ধি পাওয়াটা কাম্য নয় বলেই আরবিআই এই রিভার্স রেপো রেট বাড়ায়নি। এটাই তাদের বর্তমান নীতি।
এর ফলে কী দেখা যাচ্ছে?
ঋণের সুদের হার বাড়তে না দেওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম দেওয়া ঘোড়াগাড়ির বিপরীতমুখী দুটি ছুটন্ত ঘোড়া। এই দুটিকে আয়ত্তে রাখতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে আরবিআই-এর কালঘাম ছোটার জোগাড় হচ্ছে, বিশেষ করে এখন, কারণ বাজারে নগদ অর্থের জোগান বেড়ে গিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির ঘোড়াটা যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।
আমেরিকার ছবিটা কী?
আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি-চিত্র সেই ছোটার ছবিটা দেখিয়েছে আরও বড় করে, ভয় ধরিয়ে দিয়ে। দেখা যাচ্ছে, সে দেশের কনজিউমার প্রাইজ ইনডেক্স বা সিপিআই ৭.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৯৮২ সালের পর যা সবচেয়ে বেশি বাৎসরিক বৃদ্ধি। বৃহস্পতিবার এই তথ্যটিই শেয়ার বাজারে এসে পড়েছে কার্যত বোমার মতো। আরবিআই বৃহস্পতিবারই জানিয়েছিল, তারা আগামী অর্থবর্ষে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের ব্যাপারে আশাবাদী। মুদ্রাস্ফীতির হার-ও কম দেখিয়েছে তারা পূর্বাভাসে। তার পর শেয়ার বাজার উঠতে দেখা গিয়েছিল কিন্তু আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতির এই চড়চড়ানি-টা বাজারকে হু-হু করে নামিয়ে দিয়েছে। শুক্রবার সেনসেক্স হাজার পয়েন্ট নেমে যায় বাজার খোলার পর। নিফটি পড়ে যায় ২৬৮ পয়েন্ট।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার না বাড়ালেও, মার্কিন মুলুকের ফেডেরাল রিজার্ভকে এই পর্বতপ্রমাণ মুদ্রাস্ফীতির ডানা ছাঁটতে গেলে সেই কাজটি করতে হবে। ভারতের সঙ্গে তাদের অর্থনীতির গুণগত ফারাক বিশাল। ফলে ঋণের সুদ বৃদ্ধির চেয়ে বাজারে দাম-বৃদ্ধির ঘুড়িটাকে নামানোটা তাদের কাছে বেশি জরুরি। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, এই বৃদ্ধি ফেডেরাল রিজার্ভের পেটে একটি সজোরে ঘুঁসি, ফলে তাদের এখন ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়াতে হতে পারে তারা সুদের হার। ফেডেরাল রিজার্ভ আগেই জানিয়েছিল, তারা সুদের হার বৃদ্ধি করবে মার্চে। অনেকেই বলছেন, ফেডেরাল রিজার্ভের আসন্ন সুদ বৃদ্ধি ভারতের শেয়ার বাজারের পেটে ওই সজোরে ঘুসিই।
আরও পড়ুন আগুন বাজার, টালমাটাল অর্থনীতি, সুদের হার না বাড়িয়ে কি হাল সামলাতে পারবে আরবিআই?
মার্কিন মুলুকে সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব এ দেশে কী?
সুদের হার মার্কিন মুলুক বাড়ালে, বিনিয়োগকারীরা ভারতের বাজারে কম বিনিয়োগ করবেন। কারণ, দু'দেশের মধ্যে সুদের ফারাকটা তখন কমে যাবে। তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অর্থ এ দেশের বাজারে বিনিয়োগ করার চেয়ে ওই বাজারে বিনিয়োগ করার দিকে ঝুঁকবেন। মানে, ফরেন ক্যাপিটাল বেরিয়ে যাবে। ফেডেরাল রিজার্ভ সুদের হার বাড়াতে পারে, এই সম্ভাবনার মেঘ ঘনিয়ে ওঠার পর থেকে যা শুরুও হয়ে গিয়েছে। জানুয়ারিতে ৪১ হাজার কোটির বেশি (৪১,৩৪৬) এবং ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি (৯,৮২১ কোটি) টাকা শেয়ার বাজার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন এবার গাড়ির চাকায় গড়িয়ে অনেক দূর পাক-বিতর্ক, কী ভাবে জানেন?
এখানকার বিনিয়োগকারীদের পক্ষে এটা কতটা চিন্তার?
এটা তো বেশ চিন্তার ব্যাপারই বটে। তবে, দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ততটা সমস্যা হবে না। ফলে এখন ইক্যুইটিতে ভাল মাত্রায় বিনিয়োগ না করাই ভাল। হাইব্রিড স্কিমে কিছু অর্থ সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
আপাতত, শেয়ার বাজারে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হয়েছে। এদিনের ছবিটা হয়তো তারই ট্রেলার।