scorecardresearch

পার দু’বছর, কোভিডের সঙ্গে লড়তে হবে আর কত দিন?

পৃথিবীর গানের সুর আটকে রয়েছে করোনায়।

পার দু’বছর, কোভিডের সঙ্গে লড়তে হবে আর কত দিন?
মুম্বইয়ের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী।

পৃথিবীর গানের সুর আটকে রয়েছে করোনায়। যেন করোনা সাগরের তীরে আমরা বসে রয়েছি, একের পর এক ঢেউ দেখে চলেছি। মানব সভ্যতাকে যে ভাবে করোনা ধাক্কা দিয়েছে, তার কোনও তুলনা নেই। তবু এই এগিয়ে যাওয়া, এই লড়াই, যেখানে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সভ্যতা। কোনও ছোটবড় উঁচুনিচু-র বালাই নেই। সাম্যবাদের মহাসমারোহ এক, হয়তো বা প্রকৃতির প্রতি কৃতকর্মের ফল আমরা বুঝতে পারছি প্রতি মুহূর্তে। কত মানুষকে যে হারিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই, চোখের জলে আর এক সাগর তৈরি হয়েছে যেন। গত দু’বছর ধরে এই হাল। ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে দ্রুত, এক বছরে, এত তাড়াতাড়ি কোনও ভ্যাকসিনই তো তৈরি হয়নি আগে। কিন্তু করোনা আবার নিজের চেহারা বদলে এসে গিয়েছে। আলফা, বিটা, গামা। তার পর ডেল্টা। ডেল্টা একেবারে মৃত্যু-কাঁপুনি ধরিয়েছে। অন্ধকারযাত্রা যেন। এক লকডাউন পেরিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে আর এক লকডাউনে। জীবিকা হারানোর কান্না, আর্তনাদ, আর্থিক সংস্থার মহাপতনের শব্দ আমাদের ভয় পাইয়েছে। এখন চলছে ওমিক্রন। তার সুনামি। লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়াচ্ছে। কাশি, সর্দি, জ্বর, হয়েছে কি, পরীক্ষা করালেই ওমিক্রন, ব্যতিক্রম বড্ড কম। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তাই গগন-ছোঁয়া। তবে, খারাপ দিকে মোড় দিচ্ছে না এই ভাইরাস, বেশির ভাগ রোগীকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না, কিন্তু ছড়ানোর বেগেই ভয়ানক ভয়ের শিহরণ! এই যখন থরহরিকম্প চলছে, তখন দু’বছর বয়সি করোনার দিকে আমরা একটু নজর দিয়ে নিতে চাইছি। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে না তাকালে সামনেটাকে ভাল করে গলাধঃকরণ করা যায় না তো, তাই।

ভ্যাকসিনেশন

করোনার ভ্যাকসিনের আবিস্কার হয়েছে এক বছরের কম সময়ে। ইতিহাসের পথে একটু হাঁটলেই বোঝা যায়, এমন কোনও উদাহরণ আর নেই। মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় অবিস্কার বোধ হয় এইটিই। এর সাফল্য হয়তো চাকা আবিস্কারের সঙ্গে তুলনীয়। বা তার চেয়েও বেশি। ২০টি ভ্যাকসিন এখন সারা পৃথিবীতে এসে গিয়েছে। ৯৩০ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে। এত বড় ভ্যাকসিনেশন ড্রাইভ, নাহ আগে কখনও হয়নি। তবে, কোনও আবিস্কারের সুফল সবাই সমান ভাবে ভোগ করতে পারে না, পারেনি, যা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এখানেও তাই হচ্ছে। আমাদের চোখ টাটিয়ে দিয়েছে। ধনী দেশগুলির ৮০ শতাংশ মানুষ যখন ভ্যাকসিনের আওতায়, তখন বেশ কয়েকটি গরিব দেশের ৮০ শতাংশই মানুষই প্রতিষেধক পাননি। ওমিক্রন যখন ২০২২-এর করোনাযুগে ছক্কা-চার হাঁকাচ্ছে, যখন বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে নানা দেশে, তখন বহু মানুষকে বেসিক ভ্যাকসিনের জন্য এই হাপিত্যেশ অপেক্ষা, মানা যায় না কিছুতেই।

শিশুদের দুনিয়াতেও প্রতিষেধকপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। সেখানেও তো বৈষম্য। কোনও কোনও দেশ সেই কাজে অনেক এগিয়ে গিয়েছে অনেক, কেউ কেউ আবার পিছনে পড়ে রয়েছে। এ দেশে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের ভ্যাকসিন দেওয়া চলছে। কিন্তু তার নীচে যারা রয়েছে, তারা কবে পাবে, বোঝা যাচ্ছে না, জানা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই তো ঘরে ঘরে শিশুদের সর্দিকাশিজ্বর শুরু হয়ে গিয়েছে, তা করোনা কিনা জানা না গেলেও ভয়ে বাবামায়েদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হচ্ছে। এদিকে কিউবা তাদের দু’বছরের ঊর্ধ্বে থাকা সমস্ত শিশুকে ভ্যাকসিন দিয়ে ফেলেছে। চিন তিন বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত শিশুকে দিয়েছে। আমাদের অবস্থানটি এর ফলে কোন অকূলপাথারে বোঝাই যাচ্ছে। এদিকে স্কুল বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের পথটা একেবারে ঘুরঘুট্টে তৈলচিত্র।

বুস্টার বিতর্ক

ভ্যাকসিন সবাইকে নিতে হবে। নিতেই হবে। ব্যাঙ্কিং সংস্থা সিটি গ্রুপ তো বলেছে, ভ্যাকসিন নাও, না হলে অন্য চাকরি খুঁজে নাও। মানে, এখনও অনেকেরই ভ্যাকসিনে বেশ কিন্তু কিন্তু আছে। তাই এমন নিদান ওই সংস্থার। এর মধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এ দেশেও তা হচ্ছে। সোমবার থেকে বুস্টার ষাটোর্ধ্ব এবং যাঁদের অন্য কোনও গুরুতর অসুখ রয়েছে ও স্বাস্থ্য কর্মী-ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা পাচ্ছেন। তবে যাঁরা যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাঁরা সেটিরই বুস্টার পাবেন। মানে, কোভিশিল্ড নিলে কোভিশিল্ডের বুস্টার, কোভ্যাক্সিন নিলে, কোভ্যাক্সিনের। কয়েকটি গবেষণা বলেছে মিশ্র ভ্যাকসিনে ক্ষতি তো হয়ই না, বরং প্রতিরোধ শক্তি বাড়ে। কিন্তু তা হচ্ছে না। হলে হয়তো দ্রুত বুস্টারের কাজটা হত।

বুস্টার কেন নিতে হবে, কেন মূল ভ্যাকসিনে কাজ হচ্ছে না, এই প্রশ্ন করছেন অনেকেই। তাঁদের জেনে রাখা ভাল, গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভ্যাকসিনের বেসিক ডোজ সম্পূর্ণ করার ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি কমে যাচ্ছে, অ্যাটিবডি হ্রাস পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে টি-সেল মেমোরি থেকেও ভ্যাকসিনের চিহ্ন গায়েব হয়ে যাচ্ছে। ফলে বুস্টারের প্রয়োজন রয়েছে, অ্যান্টিবডির পুনরুজ্জীবনের জন্য। ২০২১-এর অগস্টের শেষ থেকেই ধনী দেশগুলি বুস্টার দিতে শুরু করে দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের ভ্যাকসিন নীতির বিরুদ্ধে হেঁটেই। কারণ, ভ্যাকসিনের সাম্যের কথা বলছিল হু। বলছিল, বহু দেশের বহু মানুষ যেহেতু মূল ডোজ পাননি, ফলে সেই অভিযানই জোরদার ভাবে চালানো উচিত। বুস্টার দিতে শুরু করলে ভ্যাকসিনে বৈষম্য আরও অনেক গুণ বাড়বে। কিন্তু বহু দেশের সাফ কথা, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, বুস্টার চালু করায় কোনও ভুল নেই। বৈষম্যকে গুলি মারো তাই। এখন অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ঠিক করেছিল সেই সব দেশ। তাই এখন তারা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে বুক ঠুকে দাঁড়াতে পারছে। যদিও বুস্টার ওমিক্রন রুখতে পারবেই কি না, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুস্টারের রাস্তায় বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি তারা ১৪ বছরের উপরের ছেলেমেয়েদের ফাইজারের বুস্টারে দিয়েছে গ্রিন সিগনাল। বুস্টার বেশ কয়েকটি দেশে এখন বাধ্যতামূলক। আর কোভিড ভ্যাকসিনেশনের দুনিয়ার নেতা ইজরায়েল তো আরও এগিয়ে। তারা চতুর্থ ডোজ দিতে শুরু করে দিয়েছে।

ভাইরাসের বদল

করোনার বদলের পর্ব চলছে। যে কোনও ভাইরাসই তো বদলায়। বদলাতে বদলাতে তা মানুষের সঙ্গে রয়ে যায়, বা হারিয়ে যায়। তাই করোনার সঙ্গে আমাদের জীবনযাপনের অভ্যেস করতে হবে। অভ্যেস তো হয়েই গিয়েছে অনেকটা। আম মানুষ এখন আর ভাইরাসকে তেমন ভয় পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে, অতি সাহস দেখানো মোটেই ভাল নয়, সেই সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা, সরকার, বার বার। ওমিক্রন অনেক গুণ দ্রুত ছড়ায়, এই ভাইরাস ৫০ বার বদলের ফলে তৈরি, তৈরি হয়েছে সম্ভবত কোনও এডস রোগীর শরীরে, দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু ওমিক্রনের সৌজন্য এখন প্যান্ডেমিকের সবচেয়ে ঝোড়ো সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। যেন টি-টোয়েন্টি খেলা চলছে ভাইরাসের। চোখের পলক পড়ার আগেই কেউ আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন ওমিক্রনে। কমন কোল্ড যাকে বলে ইংরেজিতে, মানে একটু সর্দি, কাশি এবং জ্বর-জ্বর ভাব, বা অল্প অল্প জ্বর, এই হল উপসর্গ। ভাইরোলজিস্টদের মত, ওমিক্রন যেহেতু অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে, তাই দ্রুত এর নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু এর পর কি? চতুর্থ কোনও ঢেউ আসবে নাকি?

আরও পড়ুন দেশে চালু বুস্টার, কিন্তু নয় মিশ্র ভ্যাকসিন, কত দিনে বুস্টার ডোজ পাবেন আপনি?

আগে এবং এখন

করোনার সুনামি যখন আছড়ে পড়েছিল, তখন যেমনটি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমরা, এখন স্বাভাবিক ভাবেই সেই পরিস্থিতি নেই। বাঁচার স্বার্থে অনেকটা সামলে উঠতে হয়েছে। লড়াই করতে করতে এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে একে একে অস্ত্রও এসে যাচ্ছে হাতে। আমরা বুঝতে পেরেছি ভ্যাকসিন নিতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব যতটা সম্ভব মানতে হবে। ভারতের মতো গরিব এবং বিশাল জনসংখ্যার দেশের পক্ষে করোনার সঙ্গে লড়াই মোটেই সহজ কথা নয়। তবু ভারত লড়াইয়ে অনেক দ্রুত, অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। দেড়শো কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আমাদের রক্তে ঘুরছে, গত বছর ভ্যাকসিনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে না পারলেও, এটা কম কিছু নয় মোটেই। তা ছাড়া, এসেছে দুটি ওষুধ। মার্ক সংস্থার মোলনুপিরাভির এবং ফাইজারের প্যাক্সলোভিড। ফাইজার জানিয়েছে, তাদের ওষুধ প্রাপ্তবয়স্ক কোভিড রোগীদের মৃত্যু বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। যা নাকি প্রমাণিত ক্লিনিকাল ট্রায়ালে। ব্রিটেন আড়াই লক্ষ প্যাক্সলোভিড কিনছে। আর মার্কের মোলনুপিরাভিরকে নভেম্বরেই ছাড়পত্র দিয়েছে ব্রিটেন। ১৮-ঊর্ধ্বদের জন্য এই ছাড়পত্র। সোমবার আমেরিকান সংস্থা মার্কের এক কর্তা দাবি করেন, তাঁদের ওষুধ নাকি ওমিক্রনের বিরুদ্ধেও কাজ করার শক্তি ধরে। ভারতে অবশ্য মলনুপিরাভির নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আইসিএমআর মঙ্গলবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা মলনুপিরাভিরকে কোভিডের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করছে না। এর সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইসিএমআর।

যাই হোক না কেন, ভ্যাকসিন, ওষুধ, সচেতনতা এবং লড়াই– আমরা অনেকটা তৈরি। সভ্যতা যেন এক ঝটকায় বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। সে যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই আর চিনতে পারছে না। তার গর্বে এসেছে বিরাট ধাক্কা, চওড়া ফাটল। সে দাঁড়িয়েছে মাটির উপরে।

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Explained news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Explained fight against coronavirus two years on